সরস্বতী পূজার আগে কুল বা বরই খাওয়া বারণ কেন ?

0

সরস্বতী পূজার আগে কুল বা বড়ই খাওয়া বারণ কেন ?

সরস্বতী পূজার আগে কুল খেতে নেই কেন ?

সরস্বতী পূজা না হওয়া পর্যন্ত অনেকে কুল বা বড়ই ফল খায় না । তিথির ফেরে সরস্বতী পূজা হয় কোনো বছর পৌষ মাসের শেষে, কোনো বছর মাঘের মাঝামাঝি, আবার কোনো বছর হয় মাঘ মাসের শেষে । যে বছর পূজা পৌষ মাসের শেষে বা মাঘ মাসের মাঝামাঝি হয়, সেই বছর পূজা শেষ করে কুল বা বড়ই হয়তো বাজারে বা গাছে পাওয়া যায়, কিন্তু যে বছর পূজা মাঘের শেষে হয় সেই বছর পূজা শেষে খাওয়ার জন্য কুল পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে । তাই সরস্বতী পূজা না করে বড়ই খাবো না, এই ধরণের প্রতিজ্ঞা করলে আপনি শুধু বড়ই ফলের পুষ্টি থেকে বঞ্চিতই হবেন, আর ফলের পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়ে যদি নিজের মেধা কমান তাহলে সরস্বতী মাতা আপনার উপর কোনোভাবেই খুশী হবে না । তাই পূজা না করে বড়ই খাবো না, এই ধরণের প্রতিজ্ঞা করার কোনো দরকারই নেই; কারণ, বোরোই অন্য ফলের মতোই একটি ফল ।

যে মৌসুমে যে ফল পাওয়া যায়, সেই মৌসুমে অনুষ্ঠিত পূজায় সাধারণত সেই ফল প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হয়, সরস্বতী পূজায় বোরোই দেওয়াও সেই রকমই একটি ব্যাপার, সরস্বতী পূজায় যে বোরোই দিতেই হবে এমন কোনো বিধি নিষেধও নেই, তাই সরস্বতী পূজা না করে বোরোই না খাওয়ারও কোনো যুক্তি নেই এবং এর কোনো প্রয়োজনও নেই । বোরোই যখন থেকে গাছে ধরবে বা বাজারে পাওয়া যাবে তখনই থেকেই খাওয়া শুরু করবেন, এতে বোরোই ফলের পুষ্টির কারণে যদি আপনার মেধা বুদ্ধি বৃদ্ধি পায়, তাহলেই দেবী সরস্বতী আপনার উপর খুশি হবেন । দেহে পুষ্টির অভাব থাকলে মেধার বিকাশ ঠিক মতো হয় না, আর এমন হলে বছরে প্রত্যেকদিন সরস্বতীর পূজা করেও আপনার লাভ ঘটবে না । তাই পাওয়া মাত্র ইচ্ছা মতো বোরোই খান, আর পূজার দিন উপবাস থেকে ভক্তি সহকারে সরস্বতী পূজা করুন, দেবী মাতা আপনার উপরে সন্তুষ্ট হবেন ।

সরস্বতী পূজায় কুল না খাওয়া সম্পর্কে যে গল্পটি নেটে ঘুরে বেড়ায়, খেয়াল করে দেখবেন তার কোনো শাস্ত্রীয় রেফারেন্স নেই। ব্যাসদেবের জন্মের আগে থেকেই কূল বা বদরিকা ফলের গাছে ঘেরা বদরিকা আশ্রম ছিলো, জন্মের পর ব্যাসদেব সেখানেই যান এবং শিক্ষা লাভ করেন, আর কেউ কূল গাছের নিচে বসে থাকলে তার মাথায় পাকা কুল পড়তেই পারে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই ।


তাছাড়া সাধনায় সিদ্ধি লাভের নির্দিষ্ট কোনো সময় হয় না, কিন্তু কুল বীজ লাগানোর পর তা থেকে ফল পেকে মাটিতে পড়ার একটি নির্দিষ্ট সময় আছে । তাই কূল বীজ লাগানোর পর, সেই কূল বীজ থেকে গাছ হয়ে, তাতে ফল ধরে সেই ফল মাথায় পড়লে সাধনায় সিদ্ধি লাভ হবে ব'লে- ব্যাসদেব, সরস্বতী এবং কুল না খাওয়ার যে গল্প ফাঁদা হয়েছে, আসলে সেটা একটা মিথ্যা প্রচার । এত কম এবং কোনো নির্দিষ্ট সময়ে সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা একটা গাঁজাখোরি কল্পনা মাত্র ।

এছাড়াও ব্যাসদেব ছিলেন পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণেরই একটা রূপ (গীতা, ১০/৩৭), তাই ব্যাসদেবের সাধনা করে সিদ্ধি লাভ করার কোনো প্রয়োজনই নেই । তারপরও ব্যাসদেব প্রকৃতির নিয়ম মেনে বদরিকাশ্রমে গিয়ে শিক্ষা লাভ করেছিলেন ।
যেমন- পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ, সন্দিপনি মুনির নিকট শিক্ষা লাভ করেছিলেন; কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের এই শিক্ষালাভ ছিলো প্রকৃতির নিয়ম মেনে লোক দেখানো মাত্র । কেননা, তিনিই তো সকল জ্ঞান ও শক্তির উৎস, তাই তার আবার শিক্ষালাভের প্রয়োজন কী ? একই কারণে শ্রীকৃষ্ণের একটি রূপ হওয়ায় ব্যাসদেবেরও তথাকথিত শিক্ষা লাভের কোনো প্রয়োজন ছিলো না, সাধনায় সিদ্ধি লাভের পর তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন এবং তারপর শাস্ত্রগ্রন্থগুলো রচনা করেছেন, এমনটা ভাবা মূর্খামির পরিচয় মাত্র।

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, শ্রীকৃষ্ণই যদি সকল জ্ঞান ও শক্তির উৎস হয়ে থাকে, তাহলে তাঁর আবার লোকদেখানো শিক্ষা লাভের প্রয়োজন কী ? এই প্রশ্নের জবাব শ্রীকৃষ্ণ গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের ২১-২৫ নং শ্লোকে দিয়ে রেখেছেন, সেখানে তিনি বলেছেন :

"শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যা যা করেন, সাধারণ লোকও সেই সেই কর্ম করে থাকে । শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যা স্থির করেন, সাধারণ জনও তাই মেনে চলেন ।

হে পার্থ, ত্রিলোকে আমার করণীয় কিছু নাই । ত্রিভুবনে আমার পাওয়ার বা না পাওয়ার কিছু নাই, তবু আমি কর্ম করিয়া যাইতেছি ।

হে অর্জুন, আমি অনলস হইয়া কর্ম করিতেছি । যদি তাহা আমি না করিতাম, তবে নিশ্চয়ই মানবগণ আমারই পথ অনুসরণ করিত ।

আমি যদি কর্ম না করি, তবে এ সকল ব্যক্তি উচ্ছন্নে যাইবে । আমার কারণেই বর্ণসঙ্করের সৃষ্টি হইবে এবং সকল ব্যক্তি আমার দোষেই বিনষ্ট হইবে ।

হে ভারত, অজ্ঞ ব্যক্তিরা কর্মে আসক্ত থাকিয়া যেমন কর্ম করে, জ্ঞানীরা কর্মে আসক্ত না হইয়া লোকশিক্ষার জন্য সেইরূপভাবেই কর্ম করিয়া থাকেন ।"

শ্রীকৃষ্ণের এইসব কথা থেকে একটা স্পষ্ট যে, শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা লাভ এবং কর্ম করার কোনো প্রয়োজন না থাকলেও, লোকশিক্ষার জন্য তিনি সেগুলো করেছেন; কারণ, তিনি মানবগণের আদর্শ । শ্রীকৃষ্ণের একটি রূপ হওয়ায় এই একই কারণে ব্যাসদেব বদরিকাশ্রমে গিয়ে শিক্ষা লাভ করেছেন, যা ছিলো মূলত লোকদেখানো এবং লোকশিক্ষার উদ্দেশ্যে, তাই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে সরস্বতী দেবীকে সন্তুষ্ট করার কোনো ব্যাপার এখানে নেই, আর ব্যাসদেবের মাথায় কূল পড়ারও কোনো ব্যাপার নেই । তাই নিশ্চিন্ত মনে কূল খেয়ে যান এবং সরস্বতী পূজার ক্ষণ উপস্থিত হলে শ্রদ্ধার সাথে তাঁর আরাধনা করুন ।

শেষে আরেকটি বিষয়- ধুমধাম করে দেবী সরস্বতীর পূজা করলেই যে আপনি পড়াশোনায় ভালো করবেন বা জ্ঞানী হবেন, এর কোনো গ্যারান্টি নেই । পৃথিবীর যেকোনো জাতির লোক, তারা সরস্বতীর পূজা করুক বা না করুক, তারা জেনে বা না জেনেও যদি সরস্বতী পূজার সেই শিক্ষাগুলোকে পালন করে বা মেনে চলে, তাহলে তারাও বিদ্যা লাভ করবে বা জ্ঞানী হবে । মূলত নিজের অজ্ঞাতে সরস্বতী পূজার এই শিক্ষাগুলোকে কাজে লাগায় বলেই মুসলমানদের মধ্যে কিছু লোক এবং ইহুদি খ্রিষ্টানরা জ্ঞান লাভ করতে পারে বা পারছে । তাই মুসলমানরা সরস্বতী পূজা নিয়ে যতই নাক সিটকাক বা কটূক্তি করুক না কেনো, তারা যে বিদ্যা বা জ্ঞান লাভ করছে, তা সরস্বতী পূজার শিক্ষাকে কাজে লাগিয়েই করছে ।

আশা করছি- উপরের আলোচনা থেকে, সরস্বতী পূজার আগে বড়ই খাওয়া যাবে কি যাবে না এবং অন্য জাতির লোকেরা সরস্বতী পূজা না করেও কিভাবে জ্ঞান লাভ করে, সেই বিষয়টি আমার বন্ধুদেরকে বোঝাতে পেরেছি ।


আরও পড়ুন :

একাদশীর পারন মন্ত্র

সরস্বতী পূজা পদ্ধতি

নমস্কার কেন করা হয় ?

মোক্ষদা একাদশী মাহাত্ম্য

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top