কর্ণ নাকি অর্জুন কে বেশি শক্তিশালী ? যুক্তিযুক্ত বিচার

0

কর্ণ নাকি অর্জুন কে বেশি শক্তিশালী ? যুক্তিযুক্ত বিচার

অর্জুন নাকি কর্ণ কে বেশি শক্তিশালী ?

বর্তমান সময়ে আমাদের মহাকাব্য মহাভারত বিকৃত করে নির্মিত কিছু ইন্ডিয়ান টিভি সিরিয়ালের কারণে আমাদের মধ্যে এই বিভেদ টা চরমে পৌঁছেছে! এগুলো আসলে চরম বামপন্থী লোকজনদের কাজ । কদিন পর এরা রাবণকে নিয়েও টিভি সিরিয়াল বানাবে, আর তার সাথে মহাকাব্যের কোনো মিল থাকবে না । তখন মানুষ এই টিভি সিরিয়াল দেখে বলবে রাবণই প্রকৃত হিরো আর রামচন্দ্র অধার্মিক । এরকম কোনো বিকৃত টিভি সিরিয়াল যদি মুসলিমদের কোনো ধর্মগ্রন্থ নিয়ে বানানো হতো তাহলে সেটা তারা কখনোই সহ্য করতো না । কারণ তারা তাদের ধর্মগ্রন্থকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে । গতকাল মুক্তি পাওয়া প্রভাসের কল্কি সিনেমাতে দেখলাম অশ্বত্থামা বলছে, কর্ণ সেকালের সবচেয়ে বড় যোদ্ধা ও ভালোমানুষ ছিলেন । এইটা কোনো কথা, আমার মনে হয় এই সিনেমার ডিরেক্টর কোনোদিনও মহাভারত পড়েননি । ঐ টিভি সিরিয়াল দেখেই মহাভারত সম্পর্কে জেনেছেন ।

যেভাবে একজন হিজরা নিজেকে নারী অপেক্ষা সুন্দরী দেখানোর জন্য অতি শৃঙ্গার করে নিজের শরীরের সঙ্গে ঘোর অপরাধ করে ফেলে । তেমনি একজন সংকীর্ণ, কুন্ঠিত, অজ্ঞানী হিন্দু ধর্মগ্রন্থকে বিকৃত করে নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতির সাথেই অন্যায় করে ফেলে । - ব্যোমকেশ

এদের উদ্দেশ্য হলো কর্ণ, দুর্যোধন ও রাবণের মতো পাপাচারী ব্যক্তিদেরকে আমাদের সামনে ট্র‍্যাজিক হিরো আখ্যা দেওয়া । যাতে হিন্দুধর্ম খুব তাড়াতাড়ি বিনষ্ট হয় । প্রকৃত সত্য না জেনে, শুধু মাত্র টিভিতে দেখা বিকৃত কাহিনী নির্ভর মহাভারত সিরিয়াল দেখেই আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই! যার কারণে আমরা পাপাচারী কর্ণের সাথে অর্জুনের মতো মহান এক যোদ্ধার তুলনা করি । যিনি কিনা শ্রীকৃষ্ণের প্রধান সহচর ছিলেন । আজকাল বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে দেখছি আধুনিক যুগের ছেলেপেলেরা শুধু মাত্র কর্ণকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার জন্য অর্জুনকে সমানে গালাগাল করে যাচ্ছে । আর তারা বিকৃত টিভি সিরিয়াল দেখে সেখান থেকে যুক্তি দিয়ে যাচ্ছে । আর তারা কর্ণের সাথে অর্জুনের মতো মহান এক যোদ্ধার তুলনা করে । যে কিনা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রধান সহচর ছিলেন । ছিঃ ছিঃ ছিঃ কি লজ্জাজনক । হিন্দু ছেলেমেয়েরা নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থ না পড়ে শুধুমাত্র টিভি সিরিয়াল দেখে নিজেদের ধর্মকে অপমানিত করতেও কুন্ঠাবোধ করছে না । আজ আমরা টিভি সিরিয়াল নয়, অরিজিনাল মহাভারত থেকে কর্ণের মুখোশ উন্মোচন করবো ।

কর্ণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে নিচের ভিডিওটি দেখতে পারেনঃ

কিছু মানুষ সিরিয়াল দেখে অর্জুনের সাথে কর্ণের তুলনা করেন । কর্ণের সেই যোগ্যতাই ছিলো না কখনো । এজন্যেই মহাভারতের বাংলা অনুবাদক রাজশেখর বসু বলেছেনঃ 

আমরা কর্ণ চরিত্রের নীচতা ও মহত্ব দুইই দেখতে পাই (নীচতাই বেশী),
কিন্তু তাঁর সমন্বয় করতে পারি না । -রাজশেখর বসু

আরে অর্জুনের মতো মহান যোদ্ধা মহাভারতের যুগে আর কেউ ছিলো কিনা আমার জানা নেই । দেবতারা পর্যন্ত যে রাক্ষসদের পরাজিত করতে পারেনি । অর্জুন সেই রাক্ষসদের অর্জুন একদিনের যুদ্ধেই বধ করে ফেলেন । তথাকথিত কর্ণ ভক্তরা এখনই দৌড় দিবেন না । দাড়ান, আরো আছে । অর্জুন মহাবীর হওয়া সত্ত্বেও নারীদের প্রতি ছিলেন যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল । চিত্ররথের সঙ্গে স্বর্গে যাওয়ার পর উর্বশীর প্রতি তার ব্যবহার আমাদের সকলের হৃদয়কে জয় করে নিয়েছে ।

আর দ্যুতসভায় যখন দ্রৌপদীকে আনা হয় । তখন কর্ণ দুঃর্যোধনকে কোনো রকম বাধাপ্রদান করেন নি । যদি তিনি তখন দুঃর্যোধনকে বাধা দিতেন তাহলে তখন দ্রৌপদী এতো অসম্মানের শিকার হতো না । সেটা তো তিনি করলেনই না বরঞ্চ তিনি সকলের সামনে দ্রৌপদীকে বেশ্যা বলে সম্বোধন করে নিজের আসল চরিত্রের পরিচয় দিলেন । প্রকৃতপক্ষে কর্ণের মধ্যে না ছিল সহনশীলতা আর না ছিল ধর্ম । তার মধ্যে ছিল কেবল মিথ্যাচারিতা, স্বার্থপরতা এবং ব্যক্তিত্ত্বহীনতা ।

পান্ডবদের জতুগৃহে পুড়িয়ে মারার ষড়যন্ত্র, ভীমকে বিষাক্ত খাদ্যের সাহায্যে মারার চেষ্টা, দ্রৌপদীকে "বেশ্যা" আখ্যা দিয়ে দুর্যোধন এবং দুঃশাসন কে বস্ত্রহরনের জন্য প্ররোচিত করা, কথায় কথায় ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য ইত্যাদি বয়োজ্যেষ্ঠদের অপমান ও অসম্মান করা । কর্ণের এই সকল গুণএর কথা তো কমবেশি প্রত্যেকেই জানে ।

কর্ণ নাকি অর্জুন কে বেশি শক্তিশালী ? যুক্তিযুক্ত বিচার
Arjuna

আরো জানুনঃ অর্জুন শারীরিকভাবে কতোটা শক্তিশালী ছিলেন ?

কর্ণ সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণের এই বাক্যটি শুনুনঃ

অশ্বত্থামা, কৃতবর্মা, শল্য, কৃপ -এদের প্রতি তোমার দয়া থাকতে পারে, কিন্তু পাপমতি ক্ষুদ্রাশয় কর্ণকে তুমি সত্বর বধ কর । জতুগৃহদাহ, দ্যুতক্রীড়া এবং দুর্যোধন তোমাদের উপর যত উৎপীড়ন করেছেন সে সমস্তেরই মুল এই দুরাত্মা কর্ণ । - কর্ণপর্ব

যারা মনে করেন কর্ণকে অন্যায় ভাবে বধ করা হয়েছে তারা মহাভারত পড়েছেন বলে আমার মনে হয় না । কারন কর্ণের রথের চাকা যখন পৃথিবী আঁকড়ে ধরে তখন সে অর্জুনকে উদ্দেশ্য করে (একপ্রকার স্তুতি করেই বলে) বলেঃ

"হে কৌন্তেয়, একটু অপেক্ষা করো, আমার রথের চাকাকে পৃথিবী গ্রাস করেছে । হে অর্জুন ! যে রনভূমি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, যে শরণাপন্ন, যে নিজের অস্ত্র ফেলে দিয়েছে, প্রাণভিক্ষা চাইছে, যার সকল প্রকার আয়ুধ এবং কবচ নষ্ট হয়ে গেছে, এই সকল প্রকার পুরুষের ওপর উত্তম ব্রত পালনকারী প্রহার করেন না । হে পান্ডুনন্দন ! তুমি সমস্ত লোকে মহান সুরবীর এবং সদাচারী বলে পরিচিত, তুমি যুদ্ধের সকল নিয়ম জানো । তুমি সকল বেদ-বেদান্ত অধ্যায়ন রূপী যজ্ঞ সম্পন্ন করেছ । তুমি সকল প্রকার দিব্যাস্ত্রের জ্ঞান অর্জন করে অসীম আত্মবল সম্পন্ন কার্তবীর্য অর্জুনের সমান পরাক্রমশালী হয়েছো । হে মহাবাহো ! এই সময় আমার ওপর প্রহার করে ধর্মচ্যুত হয়ো না, যতক্ষন আমি রথের চাকা ভূমি থেকে উত্তোলন করছি, ততক্ষন আমায় ক্ষমা করো ।" কর্ণপর্ব, অধ্যায়ঃ ৯১

তার উত্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেনঃ

"কি সৌভাগ্য আমাদের যে এখন এই মুহূর্তে তোমার ধর্ম মনে পড়ছে । তোমার মতো নীচ ব্যক্তি বিপদে পড়ে সবসময় দৈবের নিন্দা করে অথচ নিজের দুষ্কর্মের কথা কখনো স্বীকার করে না । হে কর্ণ ! যখন তুমি; দুর্যোধন; দুঃশাসন তথা শকুনি একবস্ত্রা, রজস্বলা দ্রৌপদী কে ভরা রাজসভায় বলপূর্বক টেনে এনে বস্ত্রহরণ করেছিলেন, তখন তোমার ধর্মবিচার কোথায় ছিলো ? শকুনি যখন যুধিষ্ঠিরকে ছল পূর্বক দ্যুতক্রীড়ায় পরাস্ত করেছিলেন, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিলো ? বনবাস এবং অজ্ঞাতবাস পূর্ণ করার পরেও যখন পান্ডবদের রাজ্য ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করা হয্‌ তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিলো  ? যখন তোমার পরামর্শে দুর্যোধন ভীমসেনের উপর বিষপ্রয়োগ করে গঙ্গায় ফেলে দিয়েছিল তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিলো  ? বারণাবর্তে জতুগৃহে ঘুমন্ত পান্ডবদের দগ্ধ করার চেষ্টা করার সময় তোমার ধর্ম কোথায় ছিলো ? যখন অসহায় দ্রৌপদীকে উপহাস করে "বেশ্যা" বলে সম্বোধন করেছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিলো? যখন বীর অভিমন্যুকে তোমরা সকলে মিলে চারিদিক থেকে ঘিরে অধর্ম অবলম্বন করে বধ করেছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিলো ? সেই সকল সময়ে যখন তোমার ধর্মের কথা মনে ছিল না, তাহলে এখন নিজেকে বিপদে দেখে যতই ধর্মের বাণী শোনাও না কেন কোনো লাভ হবে না, আজ নিয়তির হাত থেকে তোমার নিস্তার নেই" ।

এরপর কর্ণ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ধনুক ধারণ অর্জুনের সাথে যুদ্ধ শুরু করেন, এরপর দুজনের মধ্যে ভীষন যুদ্ধ হয়, কর্ণ ব্রহ্মাস্ত্র পর্যন্ত প্রয়োগ করে এবং অর্জুন ব্রহ্মাস্ত্র দিয়েই তার উত্তর দেয় । শেষে অর্জুন অঞ্জলিকা অস্ত্র প্রয়োগ করে কর্ণের ধর থেকে মস্তক ছিন্ন করে এবং কর্ণের নিথর দেহ মাটিতে পড়ে যায় । এর মধ্যে কোন অন্যায় আমি দেখতে পারছি না ।

কর্ণ নাকি অর্জুন কে বেশি শক্তিশালী ? যুক্তিযুক্ত বিচার
Karna

এবার অর্জুনের সম্পর্কে কিছু বলিঃ

যুক্তিযুক্ত কিছু পয়েন্টঃ

  • কর্ণ দ্রোণাচার্যের আশ্রমে থাকাকালীন অন্তত তার চেয়ে দশ বছরের ছোট অর্জুনের সাথে প্রতিযোগিতা করতে চেয়েছিল ব্রহ্মাস্ত্র নিয়ে । কিন্তু তিনি তার দক্ষতা দেখিয়ে প্রমাণ করতে পারেন নি যে তিনি ব্রহ্মাস্ত্রের যোগ্য । অন্যদিকে অর্জুন তার থেকে ১০ বছরের অনুজ হয়েও ব্রহ্মাস্ত্র ধারণ করার মতো দক্ষতা ও যোগ্যতা দুটোই অর্জন করে ফেলে ।
  • কর্ণ কবচ-কুন্ডল থাকা সত্ত্বেও মহারাজ দ্রুপদের কাছে হেরেছে (আদি পর্ব), অর্জুনের কাছে হেরেছে (আদি পর্ব), ভীমের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে (সভাপর্ব), গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনের কাছে হেরে পালিয়েছে (বনপর্ব) । আর টিভি সিরিয়ালে দেখিয়েছে মহারাজ দ্রুপদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে কেবল কৌরবেরাই গিয়েছিল । কর্ণ যায়নি ।

এর পরেও বলবেন কর্ণকে কবচ-কুন্ডল ছাড়া পরাজিত করা সম্ভব না । আরে মাথায় একটু বুদ্ধিও রাখুন । সিরিয়ালে চ্যানেলের টি আর পি বাড়ানোর জন্য কর্ণের বিকৃত গুণকীর্তণ শোনানো হয় ।

  • আরে কর্ণ অর্জুন তো দূরের কথা, অর্জুনের শিষ্য সাত্যকীর কাছে কয়েকবার আড়ং ধোলাই খেয়ে নিজেরই পটল তোলার যোগাড় হয়েছিল । অর্জুনের পুত্র অভিমন্যুও দুবার কর্ণি বান দিয়ে কানের চামড়া গুটিয়ে দিয়েছিল ।
  • আর যারা কর্ণকে দানবীর বলেন তাদের উদ্দেশ্যে বলছি । কর্ণ কখনোই তার কবচ কুন্ডল দান করেননি । তিনি সেটি বিক্রি করেছিলেন । কারণ তিনি ইন্দ্রকে আগেই বলেছেন আপনি কিছু না দিলে আমি আপনাকে কবচ কুন্ডল দেবো না ।
  • কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীমের কাছে কর্ণ অন্তত ৫-৬ বার হেরেছে যেখানে ভীমকে হারাতে পেরেছে মাত্র একবার । সভাপর্বেও কর্ণ ভীমের কাছে পরাজয় স্বীকার করে যুধিষ্ঠিরকে কর দিয়েছেন । বিশ্বাস না হলে সিরিয়াল না দেখে মহাভারত পড়ে দেখুন গিয়ে ।
  • দ্রুপদকে বন্দী বানানোর কাজে কর্ণ ১০০ জন কৌরব নিয়েও অসফল । সেখানে অর্জুন অন্যান্য চার পান্ডবদের সাথে নিয়ে দ্রুপদকে বন্দী করেন । কর্ণ পালিয়ে গেলেও চিত্রসেনের সাথে যুদ্ধ করে ভীমার্জুন চিত্রসেনকে পরাজিত করে দূর্যোধনকে মুক্ত করেন ।
  • একজন মানুষের পক্ষে যুদ্ধ করে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয় । অর্জুন তাও করেছিলেন ।
  • অর্জুন স্বর্গে গিয়ে কালকেয় নামক রাক্ষসদের বধ করেন । যারা দেবতাদের রাজধানী অমরাবতী দখল করেছিল একসময় ।
  • কৃষ্ণের সাথে মিলিত হয়ে খান্ডব বনের নাগ, দানব, রাক্ষস সবাইকে পরাজিত করেছেন । তিনি একাই যুদ্ধ করে নিবাতকবচদের বধ করেন । মনে রাখতে হবে দশানন রাবণও তাদের পরাজিত করতে পারেননি কখনোই ।
  • অর্জুন মল্ল্যযুদ্ধেও ভীমের সমান পারদর্শী ছিলেন । মনে আছে, শ্রীকৃষ্ণ জরাসন্ধকে সে, অর্জুন এবং ভীমের মধ্যে কাউকে বেছে নিতে বলে ছিলেন মল্ল্যযুদ্ধের জন্য ।
  • বিরাট যুদ্ধে অর্জুন একাই কর্ণ, ভীষ্ম, দ্রোণ, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য সহ সমস্ত কৌরবদের পরাজিত করেন ।

এটা কিন্তু সিরিয়ালে দেখানো হয় নি । এগুলো কি অর্জুনের শ্রেষ্ঠত্ব ও বীরত্ত্ব প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট নয় ?

  • এছাড়াও তিনি বিরাটযুদ্ধে কর্ণের সামনেই কর্ণের ভাই সংগ্ৰামজিৎকে মারেন , কর্ণের বাম কানের চামড়া গুটিয়ে দেন এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দুবার পালাতে বাধ্য করেন ।

তবে একটা ব্যাপার মানতেই হবে, কর্ণ যোদ্ধা বা ধনুর্ধর হিসেবে শ্রেষ্ঠ নয় তো কি হয়েছে যুদ্ধ থেকে পলাতক হিসেবে তার কোনো তুলনা হয় না । অর্জুন এখানে কর্ণকে সরাসরি কাপুরুষ হিসেবে ভর্ৎসনা করে বলেনঃ

"রে রাধেয়! তুমি এইমাত্র নিজের ভাইকে না বাঁচিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচিয়েছ, তাও তু্মি সাধুসমাজে নিজের গর্ব কর, অতএব তোমার সমান নির্লজ্জ ও কাপুরুষ সারা পৃথিবীতে নেই"।

কর্ণ নাকি অর্জুন কে বেশি শক্তিশালী ? যুক্তিযুক্ত বিচার
মহান কর্ণ কেবল আত্মোহঙ্কার দেখানো এবং যুদ্ধ থেকে পালাতে জানতেন ।

এছাড়া কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সতেরতম দিনে অর্জুন কর্ণকে বলেনঃ

"হে রাধেয়, আমার পুত্র চক্রব্যূহের মধ্যে একা ছিল, আমি তার পাশে উপস্থিত ছিলাম না, সেই সময় তোমরা সকলে মিলে আমার পুত্র অভিমন্যুকে হত্যা করেছ। কিন্তু আজ আমি তোমার সামনে তোমার পুত্র বৃষসেনকে বধ করবো । ক্ষমতা থাকলে তাকে আমার হাত থেকে বাঁচিয়ে দেখাও"।

এই বলে অর্জুন কর্ণের সামনে তার পুত্র বৃষসেনকে বধ করেন ।

কিছু কিছু বামপন্থীগণ এই যুক্তি দিচ্ছেন যে অর্জুন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অন্তত তিনবার বধ হওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন । প্রথমবার: ভগদত্তের বৈষ্ণব অস্ত্র থেকে, দ্বিতীয়বার: কর্ণের একাঘ্নী বাণ থেকে ( এই অস্ত্রটি যার উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করা হতো এটি তাকেই বধ করতো), তৃতীয়বার: কর্ণের প্রয়োগকৃত নাগাস্ত্র থেকে । এখন এই কুযুক্তিগুলোরও খন্ডন করবো

প্রথমেই আসি ভগদত্তের বৈষ্ণব অস্ত্রের বেলায়:

অর্জুনের নিকটও বৈষ্ণব অস্ত্র ছিল । যার দ্বারা তিনি ভগদত্তের বৈষ্ণব অস্ত্র নিবারণ করতে পারবেন । কিন্তু তিনি এটি কেন করেননি, তা মহাভারতে অস্পষ্ট । কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভগদত্তের বৈষ্ণব অস্ত্রের এই অপব্যবহার দেখে তা ফিরিয়ে নেন । আর মনে রাখবেন, মহাভারত অনুযায়ী অর্জুনও কিন্তু ভগবান বিষ্ণুর নর অবতার ছিলেন । যার কারনে বৈষ্ণব অস্ত্রের আঘাত তার খুব একটা হানি করতো না । এই বৈষ্ণব অস্ত্র নিয়ে মহাভারতে বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে । পড়তে পারেন ।

নাগাস্ত্র:

মনে আছে অর্জুন খান্ডব বন দাহন করেছিলেন । সেখানে  তক্ষক নামে ভয়ঙ্কর সাপও মারা পড়েছিল । পরবর্তীতে তক্ষকের পুত্র অশ্বসেন অর্জুনকে বধের হেতু কর্ণের সাথে সন্ধি করে তার বাণের উপর ভর করেন ।
সিরিয়ালে দেখানো হয়েছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই অস্ত্র থেকে অর্জুনকে রক্ষা করেছিলেন । কিন্তু বাস্তবে তাই ঘটেছিল কি ? অর্জুন গড়ুড়াস্ত্র প্রয়োগ করে এই অস্ত্রের প্রতিকার করেছিলেন । গড়ুড় অশ্বসেনকে গিয়ে নিয়েছিল ইন্সট্যান্ট ।

একাঘ্নী অস্ত্র

এবার আসি কর্ণকে ভগবান ইন্দ্রের প্রদান করা বাসবী শক্তির কাছে । এই বাসবী শক্তির থেকে হাজারগুন শক্তিশালী অস্ত্র ছিল অর্জুনের কাছে । মহাভারত অনুযায়ী অর্জুনের কালকেয় ও নিবাতকবচের সাথে যুদ্ধ হয়েছিল । এই দুজন রাক্ষস এতই শক্তিশালী ছিল যে স্বর্গে তাদের আধিপত্য স্থাপন করেছিল ।
আর এদের সেনা সংখ্যা কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ করা দুই পক্ষের সৈন্যের চেয়েও বিশাল ছিল । দশানন রাবণ, তার পুত্র মেঘনাদ ও তাদের প্রবল শক্তিশালী রাক্ষস বাহিনী মিলে ১০০ বছর যুদ্ধ করেও তাদের পরাস্ত করতে পারেননি ।
অন্যান্য দেবতাসহ ভগবান ইন্দ্র তার একাঘ্নী বাণ দ্বারাও তাদের রোধ করতে পারেন নি । কিন্তু অর্জুন একাই সমগ্র অসুরবাহিনী সহ কালকেয় ও নিবাতকবচকে বধ করেন । তখন কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ তার সাথে ছিলো না । অর্জুনের এই বিজয় নিয়ে স্বর্গে তাকে নিয়ে হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল । এগুলো আমার মনগড়া কথা নয় । পড়ে দেখবেন । মহাভারতে আছে এগুলো । শক্তি অস্ত্র মহা শক্তিশালী হলেও ইন্দ্রের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে বজ্র, যা শক্তিঅস্ত্রের চেয়েও বহুগুন শক্তিশালী! এবং ইন্দ্র অর্জুনকে তার সেই বজ্র প্রদান করে ছিলেন!

অনেক সিরিয়ালপ্রেমী কর্ণভক্তরা বলেন যে ইন্দ্র তার পুত্র অর্জুনকে বাঁচানোর জন্য কর্ণের নিকট থেকে কবচ ও কুন্ডল কেড়ে নেন । তাহলে ভগবান ইন্দ্র কেন একাঘ্নী বাণ তার শত্রু কর্ণকে প্রদান করলেন ? যেখানে তিনি জানেন যে, কর্ণ নিশ্চিত ভাবে সেই একাঘ্নী বাণদিয়ে অর্জুনকে হত্যা করবে ?

কিন্তু তিনি তো তাহলে অর্জুনকেও এই শক্তি অস্ত্র প্রদান করতে পারতেন ! যাতে কর্ণের অস্ত্রের জবাব অর্জুন দিতে পারে ! কিন্তু ইন্দ্র কেন অর্জুনকে শক্তি অস্ত্র প্রদান করেন নি ?

এর কারণ হচ্ছে একটি অভিশাপ ! এজন্য আপনাদের পড়তে হবে দ্রৌপদীর সহিত হিড়িম্বার কোন্দল অধ্যায়টি ।

পাণ্ডবগণ রাজসূয় যজ্ঞ করার সময় এক ঘটনাচক্রে দ্রৌপদী হিড়িম্বাকে এই বলে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, ইন্দ্রের একাঘ্নী অস্ত্রের আঘাতে ঘটোৎকচের মৃত্যু হবে ! এজন্যেই ভগবান ইন্দ্র কর্ণকে এই বাণ প্রদান করেছিলেন । অর্জুনকে মারার জন্য নয় । কারণ তিনি জানতেন এর চেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্রও অর্জুনের নিকট রয়েছে । যা দিয়ে তিনি অনায়াসে এই অস্ত্রের নিবারণ করতে পারেনি । অপরদিকে ঘটোৎকচের নিকট কোনো দিব্যাস্ত্র ছিলো না । যা দ্বারা তিনি এই অস্ত্রের প্রতিকার করবেন । না থাকারই কথা । কারণ তার মৃত্যুর কারণ ছিল অভিশাপ ।

কর্ণভক্তরা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কেবল এটাই বলে থাকেন যে কর্ণ চারজন পাণ্ডবকে জীবন দান দিয়ে ছিলেন! অথচ কর্ণ ভীমকে একবার জীবন দান দেয়ার আগে ভীমের হাতে অন্তত ছয়বার পরাজিত এবং একবার জীবন দান পেয়েছিলেন (জয়দ্রথ বধের আগের অধ্যায় পড়লেই পাওয়া যাবে)!

এবং যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত করার আগে কর্ণ যুধিষ্ঠিরের বাণের আঘাতে জ্ঞান হারিয়ে ছিলেন!

কর্ণের অস্ত্রগুরু ভগবান পরশুরাম স্বয়ং কুরু রাজসভায় এসে অর্জুনের ব্যাপারে ধৃতরাষ্ট্র ও কৌরবদের সাবধান করেছিলেন । আর বলেছিলেন পান্ডবদের সাথে সন্ধি করে নিতে । নইলে অর্জুন তাদের বিনাশ করে দেবে । কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কর্ণ এবং অর্জুনের অন্তিম যুদ্ধের পূর্বে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ

হে সখা, আজ যদি আমি কর্ণের হাতে বধ হয়ে যাই তাহলে তুমি কী করবে!

উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন

হে ধনঞ্জয়! সূর্য আকাশ হতে নিপতিত হতে পারে! মহাসাগরও শুকিয়ে যেতে পারে! আগুনের তাপও শীতল হয়ে যেতে পারে! তবুও কর্ণ কখনই তোমাকে বধ করতে স্বমর্থ হইবে না!"

এবার আপনারাই ঠিক করুন । সিরিয়ালে দেখানো মহাভারত দেখে নয় । মহাভারত পড়ে এবং বুদ্ধি দিয়ে বিচার করুন । এবং বলুন কে শ্রেষ্ঠ ।

অর্জুন শুধু যুদ্ধবিদ্যাই নয় । চরিত্রের দিক থেকেও কর্ণের থেকে হাজারগুণে শ্রেষ্ঠ ছিলেন ।

অর্জুনকে অসম্মান কিংবা গালিগালাজ করা মহাভারতের অসম্মান, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপমান । যে যোদ্ধার কারণে আমরা গীতার মতো জ্ঞান পেয়েছি । তাকে কিনা আমরা তুলনা করছি এক নীচ পাপাচারী ব্যক্তির সঙ্গে । ছিঃ

এরপরেও যেসব স্বল্পজ্ঞানী কর্ণভক্তগণ আমার সাথে বিতর্ক করতে কিংবা গালিগালাজ করতে চান তারা মেসেজ করতে পারেন । মেসেজ বক্স নিচে গিয়ে ডানদিকে । তবে বিতর্ক হবে গঠনমূলক এবং যুক্তিযুক্ত । দয়া করে কেউ সিরিয়াল থেকে আমাকে জ্ঞান দিতে আসবেন না ।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
Post a Comment (0)
To Top