মহাভারতের যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রবিদ্যার জ্ঞান এখন কোথায় ? কেন সেই অস্ত্রগুলো হারিয়ে গেল ?

0

মহাভারতের যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রবিদ্যার জ্ঞান এখন কোথায় ? কেন সেই অস্ত্রগুলো হারিয়ে গেল ?
পৌরাণিক যুগের অস্ত্রশস্ত্র
 

রামায়ণ ও মহাভারতের যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রবিদ্যা এখন কোথায় ?



নমস্কার বন্ধুরা । আমরা সবাই রামায়ণ এবং মহাভারতের যুদ্ধ সম্পর্কে অবগত । এই যুদ্ধগুলিতে অনেক ভয়ানক সব দিব্যাস্ত্রের বর্ণনা করা হয়েছে । যেগুলো আমাদের যথেষ্ট বিস্মিত করে । আর এই অস্ত্রগুলি সম্মর্কে আমাদের বর্তমান জেনারেশনকে অনেক কৌতুহলী বানিয়ে দিয়েছে । আমাদের মনে প্রায়শই এই প্রশ্ন আসে যে মহাভারতের যুগে যে অস্ত্রগুলি ব্যবহার করা হতো সেগুলি আজকের দিনে কেন ব্যবহার করা হয় না । নাকি সেগুলি হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে ? কেনই বা হারিয়ে গেল ?

তো বন্ধুরা, আজকে আমরা আলোচনা করবো রামায়ণ এবং মহাভারতের যুগে ব্যবহৃত অস্ত্রবিদ্যাগুলি এখন কোথায় ?


এই অস্ত্রগুলিকে ভগবান পরশুরাম, রাম, লক্ষ্মণ, ইন্দ্রজিৎ (মেঘনাদ), রাবণ, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, অর্জুন এবং অন্যান্য যোদ্ধাদের মতো তীরন্দাজদের দ্বারা চিত্রিত করা হয়েছে ।

মহাভারতের যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রবিদ্যার জ্ঞান এখন কোথায় ? কেন সেই অস্ত্রগুলো হারিয়ে গেল ?
ব্রহ্মাস্ত্র

মহাভারতের যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রবিদ্যার জ্ঞান এখন কোথায় ? কেন সেই অস্ত্রগুলো হারিয়ে গেল ?
বাসবী শক্তি । যেটা দিয়ে কর্ণ অর্জুনকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন ।

মহাভারতের যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রবিদ্যার জ্ঞান এখন কোথায় ? কেন সেই অস্ত্রগুলো হারিয়ে গেল ?
পাশুপাতস্ত্র। এটি অর্জুন ভগবান শিবের কাছ থেকে পেয়েছিলেন ।

মহাভারতের যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রবিদ্যার জ্ঞান এখন কোথায় ? কেন সেই অস্ত্রগুলো হারিয়ে গেল ?
নাগস্ত্র । যেটা কর্ণ অর্জুনকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করেছিলেন । অতঃপর অর্জুন এটাকে গড়ুরাস্ত্র দিয়ে প্রতিহত করেছিলেন ।

মহাভারতের যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রবিদ্যার জ্ঞান এখন কোথায় ? কেন সেই অস্ত্রগুলো হারিয়ে গেল ?
বজ্র । ভগবান ইন্দের অস্ত্র ।

মহাভারতের যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রবিদ্যার জ্ঞান এখন কোথায় ? কেন সেই অস্ত্রগুলো হারিয়ে গেল ?
নারায়ণস্ত্র । এটি অশ্বত্থামা পান্ডবসহ তাদের সেনাদের হত্যা করার জন্য প্রয়োগ করেছিলেন । এই অস্ত্রের বৈশিষ্ট হলো যার হাতে অস্ত্র থাকবে এটি তাকেই হত্যা করবে । ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে পান্ডব সেনারা নিজেদের অস্ত্র ত্যাগ করে । যার ফলে এই মহাশক্তিমান অস্ত্র প্রতিহত করা গেছে । ত্রেতাযুগে এই অস্ত্র ব্যবহার করে রাবণের পুত্র মেঘনাদ প্রায় অর্ধেক বানর সেনা নিঃচিহ্ন করে দিয়েছিলেন ।

মহাভারতের যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রবিদ্যার জ্ঞান এখন কোথায় ? কেন সেই অস্ত্রগুলো হারিয়ে গেল ?
কর্ণের বিজয় ধনুক

মহাভারতের যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রবিদ্যার জ্ঞান এখন কোথায় ? কেন সেই অস্ত্রগুলো হারিয়ে গেল ?
সুদর্শন চক্র

মহাভারতের যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রবিদ্যার জ্ঞান এখন কোথায় ? কেন সেই অস্ত্রগুলো হারিয়ে গেল ?
ব্রহ্মশীরাস্ত্র  - এটি ব্রহ্মাস্ত্রের থেকেও কয়েকগুণ শক্তিশালী। এটির ব্যবহার করে অশ্বত্থামা উত্তরার গর্ভে থাকা পরীক্ষিতকে হত্যা করেন । পরে অবশ্য শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা পরীক্ষীত প্রাণ ফিরে পান ।

হিন্দু দেবতাদের স্বর্গীয় অস্ত্র

প্রাচীনকালে দুই ধরনের অস্ত্র ছিল;

  • শস্ত্র - শারীরিক অস্ত্র । অর্থাৎ ঢাল, তলোয়া্র বল্লম, বর্শা, কুঠার ।

  • অস্ত্র - শাস্ত্র বা ঐশ্বরিক মন্ত্র দ্বারা চালিত হাতিয়ার ।

সংশ্লিষ্ট দেবতাকে খুশি করার পর একটি অস্ত্র প্রাপ্তি করা যেতে পারে । উদাহরণস্বরূপ, ব্রহ্মাস্ত্র ব্রহ্মাকে সন্তুষ্ট করার পরে, শিবকে সন্তুষ্ট করার মাধ্যমে পাশুপতাস্ত্র, বিষ্ণুকে খুশি করার মাধ্যমে বৈষ্ণবস্ত্র ইত্যাদি অর্জিত হয়েছিল । দিব্য অস্ত্রগুলি সাধারণত তীরের মাধ্যমে আমন্ত্রিত হতো, যদিও সেগুলি সম্ভাব্য যে কোনও কিছুর সাথে ব্যবহার করা যেতে পারে । যেমন অশ্বত্থামা তার অস্ত্র হিসেবে ঘাসের ফলক ব্যবহার করে ব্রহ্মশীর অস্ত্রের আহ্বান করেছিলেন । অর্থাৎ আপনি যেকোনো বস্তুকে উপলক্ষ বানিয়ে তার মধ্যে নিজের অস্ত্রকে আহ্বান করতে পারবেন ।

একটি অস্ত্র ব্যবহার করার জন্য, একজন যোদ্ধার এই জিনিসগুলি থাকা দরকার

  • কাঙ্খিত অস্ত্রের জন্য গোপনীয় মন্ত্র ।

  • যেকোন ভৌত বস্তু যেমন ধনুক, তীর, কাঠ, ঘাসের ফলক ইত্যাদি ।

যদি যোদ্ধা যে দেবতার অস্ত্র সে ব্যবহার করবে সেই দেবতার স্তুতি করে যদি তাকে সন্তুষ্ট না করতে পারে তাহলে ঐ অস্ত্রের দেবতা তার দেহ ত্যাগ করে, এরপর অস্ত্র ব্যবহার করার চেষ্টা করে কোন লাভ হবে না, যদিও ব্যক্তিটি মন্ত্র এবং বিদ্যা (জ্ঞান) জানেন । 

কৃষ্ণ ভৌতিক জগৎ ত্যাগ করার পর অর্জুনের সাথে এটি ঘটেছিল । যারা মহাভারত সম্পর্কে বেশ খানিকটা ধারণা রাখেন তারা এই বিষয়টি সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানেন ।

কিংবদন্তি আছে যে দিব্যাস্ত্র ব্যবহার করার জন্য মন্ত্রগুলির নিম্নলিখিত বিদ্যা প্রয়োজন।

  • দিব্যাস্ত্র আহ্বান করার জন্য, একটি সিদ্ধ মন্ত্র প্রয়োজন । 

  • গায়ত্রী মন্ত্র, একটি নির্দিষ্ট উপায়ে সুরক্ষিত । এবং সুনির্দিষ্ট সুর ও উচ্চারণের মাধ্যমে ।

ভগবান রাম প্রায় ১০০০০ রথ, ১৮০০০ হাতি, ১৪০০০ ঘোড়া এবং ২০০০০০ স্থল সৈন্যকে অতিমানবীয় গতিতে তিন ঘন্টার মধ্যে হত্যা ও ধ্বংস করার জন্য গন্ধর্ব অস্ত্র ব্যবহার করেন । এটা ছিল আজকের পরমাণু অস্ত্রের মতো শক্তিশালী ।


প্রতিটি অস্ত্রের নিজস্ব অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ছিল । উদাহরণস্বরূপ, ব্রহ্মাস্ত্র ব্রহ্মার যে কোনও সৃষ্টিকে ধ্বংস করতে পারে । নাগাস্ত্র ছিল সাপের অস্ত্র । নাগপাশম ছিল নাগাস্ত্রের সমান স্বর্গীয় অস্ত্র আর গরুড়াস্ত্র ছিল নাগাস্ত্রের বিরুদ্ধে মোকাবিলার অস্ত্র । পর্বতস্ত্র ছিল একটি বিপজ্জনক অস্ত্র যা একবার আকাশ থেকে পর্বতকে পৃথিবীতে পতিত করতে ব্যবহার করা হতো ।

তিনটি সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্র রয়েছে, বৈষ্ণবস্ত্র, পশুপাতাস্ত্র এবং ব্রহ্মাণ্ডাস্ত্র । 

যাইহোক, এই অস্ত্রগুলি তিনটি প্রধান দেবতা অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিবের কোনো ক্ষতি করতে পারে না কারণ তারা ঈশ্বরের সর্বোচ্চ প্রকাশ । 

এই দিব্যাস্ত্রের মহা জ্ঞান কোথায় হারিয়ে গেল? 


দ্বাপর, ত্রেতা, সত্যযুগে মানুষের স্মৃতিশক্তি ও শারীরিক শক্তি অনেক ভালো ছিল । তারা সবকিছু সঠিকভাবে অন্তরঙ্গম করত, এবং এই দিব্যাস্ত্রগুলির জ্ঞান কোথাও লিখে রাখার খুব বেশি প্রয়োজন ছিল না । অর্জুনকে ছেড়ে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে যারা দিব্যাস্ত্র চালাতে জানতেন তাদের অধিকাংশই মারা যান । 

আর একজন যিনি জানতেন, তিনি অশ্বত্থামা । তিনি শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক অভিশপ্ত হয়ে তাঁর সমস্ত জ্ঞান ভুলে গিয়েছিলেন । তাই তিনি কাউকে অস্ত্রশিক্ষা দিতে পারেননি ।

একইভাবে, যারা অবশিষ্ট ছিল তারা এই ধরনের জ্ঞানের যোগ্য ছিল না । সেই জ্ঞান সেই প্রজন্মের সাথেই হারিয়ে গেছে । মহাভারতের যুদ্ধের পরে আর কোনো দিব্যাস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি । 

যাইহোক, অর্জুন মহাযুদ্ধের পরে কর্ণের পুত্র বৃষকেতুকে একটি অস্ত্রের জ্ঞান প্রদান করেছিলেন ।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর, কর্ণের পুত্র বৃষকেতু সেই নদীর তীরে গিয়েছিলেন যেখানে তার পিতা কর্ণ সূর্য নারায়ণের কাছে প্রার্থনা করতেন । তিনি তার পিতার সমস্ত শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন ।

অর্জুন বৃষকেতুর সামনে উপস্থিত হন এবং তাকে সবকিছু বোঝান । অর্জুন তাকে তার সাথে ধনুক এবং তীর ব্যবহারের কৌশল শিখতে, তার পিতার মতো একজন মহান যোদ্ধা হতে এবং তার পিতা যে রাজ্য শাসন করতে পারেননি তা শাসন করতে বলেছিলেন । 

অর্জুন তাকে তার পুত্রের মতো আপন করে নিয়েছিলেন এবং তাকে ব্রহ্মাস্ত্র, সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছিলেন ।

যাইহোক, বৃষকেতু ছিলেন শেষ ব্যক্তি যিনি অস্ত্র বিদ্যা সম্পর্কে জানতেন কারণ ভগবান কৃষ্ণ তাঁকে অস্ত্রবিদ্যা প্রচার করতে বারন  করেছিলেন, কারণ কলিযুগে লোকেরা ধর্ম বজায় রাখার জন্য দিব্যাস্ত্রের ব্যবহার করবে না কিন্তু ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে এর অপব্যবহার নিশ্চই করবে । 

কৃষ্ণ তাকে বলেছিলেন যে কলিযুগ শুরু হতে চলেছে এবং এই অস্ত্রগুলি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ঐশ্বরিক জ্ঞান প্রেরণ করবে না এবং বরঞ্চ এই অস্ত্রগুলি পরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাবে । এজন্য বৃষকেতু আর কাউকে এই অস্ত্রের জ্ঞান প্রদান করেন নি ।

ভগবান শিব অস্ত্রের অপব্যবহার এড়াতে কলিযুগে পাশুপতস্ত্রের মন্ত্রটি নিষিদ্ধ করেছিলেন । কলিযুগে আরেকজন ব্যক্তি রয়েছেন যার সমস্ত দৈব অস্ত্রের সম্পর্কে জ্ঞান রয়েছে । তিনি ভগবান পরশুরাম । সম্ভবত তিনি কল্কির পরামর্শদাতা এবং অস্ত্রগুরু হওয়ার অপেক্ষায় তপস্যায় রয়েছেন ।


এখন আপনি বলুন, বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আপনার কাছে যদি দিব্যাস্ত্রের জ্ঞান থাকতো তাহলে আপনি কি এর অপব্যবহার করতেন না ? নিজেকে জিজ্ঞেস করুন । তাহলেই শ্রীকৃষ্ণের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করতে পারবেন ।

নমস্কার ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top