ভীষ্মের শরশয্যা আমাদের কি শিক্ষা দেয় ?

0
ভীষ্মের শরশয্যা আমাদের কি শিক্ষা দেয় ?

ভীষ্মের শরশয্যা আসলে কিসের প্রতীক?

সনাতন ধর্মের সমস্ত কাহিনী কোনো না কোনো ঘটনার প্রতীক । অর্থাৎ এই কাহিনীগুলো পৃথিবীর কোনো না কোনো বাস্তবতাকে প্রকাশ করে । এ কারণে পৃথিবীতে এমন কোনো ঘটনা নেই যার কোনো না কোনো ইঙ্গিত সনাতন ধর্মের কাহিনীতে নেই, আবার সনাতন ধর্মে যে ঘটনার ইঙ্গিত নেই, তার বাইরে পৃথিবীতে কোনো ঘটনাও ঘটবে না ।

মহভারতে- সত্যবতী যেমন লালসার প্রতীক, অর্জুন যেমন অনুরাগের প্রতীক, তেমনি ভীষ্ম ছিলেন ভুলের প্রতীক । সমগ্র মহাভারত জুড়ে এই ব্যক্তির প্রায় সমস্ত কাজ ছিলো ভুল । যেমন তাঁর বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত ছিলো ভুল, রাজা না হওয়ার সিদ্ধান্ত ছিলো ভুল, সত্যবতীর আদেশ বিনা প্রশ্নে পালন করে, তার সৎ ভাই বিচিত্রবীর্যের জন্য তুলে আনা ছিলো ভুল, ক্ষমতা দেখিয়ে গান্ধার রাজের কন্যা গান্ধারীর সাথে ধৃতরাষ্ট্রের বিয়ে দেওয়া ছিলো ভুল এবং শেষ পর্যন্ত অধর্মী জেনেও দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করাও ছিলো ভীস্মের ভুল ।

ভীস্মের এই সমস্ত কার্য যে ভুল ছিলো, তার প্রমাণ হলো- ভীষ্ম বিয়ে করেন নি এবং রাজা হন নি এই কারণে যে, যাতে তার বংশধর এবং সত্যবতীর বংশধরদের মাঝে রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে কোনো যুদ্ধ না হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ঘটেছিলো এবং সেটাই ছিলো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, তার মানে ভীষ্ম যে কারণে রাজা হন নি বা বিয়ে করেন নি, সেই সিদ্ধান্তই তাঁর প্রথম ভুল ছিলো । এভাবে ভীষ্ম সারাজীবন ধরে তাঁর ক্ষমতার জোরে যত কাজ করেছেন সবগুলোই প্রায় ভুল ছিলো । এই সব ভুল সম্মিলিতভাবে ভীষ্মের শেষ জীবনে এসে তাকে তীর হিসেবে আঘাত এবং সে তীরের উপরই তাঁর শয্যা হয় ।

শিখণ্ডী ও অর্জুনের তীরে ভীষ্মের দেহ ক্ষত বিক্ষত হলেও, তীরগুলো খুলে নিয়েও কিন্তু ভীষ্মকে শয্যাশায়ী করে রাখা যেতো, তার মৃত্যু পর্যন্ত । কিন্তু মহাভারতে সেটা করা হয় নি, এর কারণ হলো- তাহলে মানুষের শেষ জীবনে ভুলের কর্মফল হিসেবে মানুষ যে শয্যাশায়ী হিসেবে কষ্টটা পায়, সেটার প্রকাশ পেতো না ।

আপনারা খেয়াল করলে দেখবেন যে অনেক মানুষ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে নানা অসুখ বিসুখে চলৎশক্তি হারিয়ে বা ব্রেইন স্ট্রোক করে প্যারালাইজড় হয়ে যায়, তারা আর একা একা চলতে পারে না বা একা একা পায়খানা প্রস্রাব করতে পারে না, তারা বিছানাতেই পায়খানা প্রস্রাব করে এবং অন্যদেরকে সেগুলো পরিষ্কার করে দিতে হয়, এদেরকে সব সময় বিছানায় শুয়ে থাকতে হয় এবং মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করতে হয়, যেভাবে উত্তরায়ণের নির্দিষ্ট সময় আসার জন্য মৃত্যুশয্যায় শুয়ে প্রতীক্ষা করতে হয়েছিলো ভীষ্মকে। এই মৃত্যুশয্যায় শুয়ে থাকার সময় মানুষ যে বিভিন্ন রকম শারীরিক কষ্ট পায়, সেটাই আসলে শরীরে তীর বিদ্ধ হওয়ার কষ্ট, যেটা প্রকাশ করা হয়েছে ভীষ্মের শরীরে তীর বিদ্ধ করে রেখে শয্যাশায়ী করে রাখার মাধ্যমে ।

কথায় বলে- শেষ ভালো যার, সব ভালো তার । এই কথা আসলে বলা হয়েছে মানুষের জীবনের অন্তিম সময়কে উদ্দেশ্য করে । যে মানুষ ভালো মৃত্যুকে অতিক্রম করে, যার মৃত্যু হয় যন্ত্রণাহীন, মৃত্যুর পূর্বে যে ব্যক্তিকে শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হয় না, বিছানায় পায়খানা প্রস্রাবের মধ্যে থাকতে হয় না, নিজের খাওয়া বা ছোট খাটো কাজের জন্য যাকে অপরের উপর নির্ভর করতে হয় না, সেই ব্যক্তি অবশ্যই সৎ বা ভালো এবং যেহেতু তার মৃত্যু হয়েছে ভালো ভাবে, সেহেতু সে সারাজীবন সৎ বা ভালো জীবন যাপন করেছে, সেকারণে এই কথা বলা হয়েছে যে, শেষ ভালো যার, সব ভালো তার ।

এর বিপরীতে যে ব্যক্তি মৃত্যু শয্যায় শুয়ে কষ্ট পায়, বিছানায় পায়খানা প্রস্রাবের মধ্যে থাকতে বাধ্য হয় এবং এভাবে যে মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর ধরে ভুগতে থাকে, সেই ব্যক্তির জীবন যাপন বা বিশ্বাস যে অবশ্যই খারাপ ছিলো এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় । কারণ, তার জীবন যাপনে যদি ভুল না থাকতো, সে কখনো মৃত্যুশয্যায় শুয়ে কষ্ট পেতো না, যেহেতু তার শেষ জীবনে ভালো নয়, সেহেতু সে ভালো ছিলো না, এটা নিশ্চিত । সারাজীবন ধরে বিভিন্ন ভুল করা, যাকে বলে পাপ, এই ভুল বা পাপগুলোই আসলে ভীষ্মের শরীরে বিদ্ধ হওয়া তীরের মতো মানুষকে মৃত্যু শয্যায় কষ্ট দেয় এবং যতক্ষণ তার পাপের ফল সে কষ্টের মাধ্যমে না পাচ্ছে, ততক্ষণ তার মৃত্যু হয় না ।

কোনো নারী যদি তার স্বামী সাথে আচরণ খারাপ করে, বিভিন্নভাবে স্বামীকে কষ্ট দেয়, এমনকি ধর্মীয় কাজ বা আচার পালন করতে গিয়ে স্বামীর প্রতি কর্তব্যকে অবহেলা করে, সেই সাথে পরিবারের অন্যদের সাথেও অন্যায় আচরণ কর, মৃত্যুশয্যায় ভীষ্মের মতো কষ্ট পাওয়া থেকে সেই নারীকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না । একই ভাবে কোনো পুরুষ যদি অসৎ জীবন যাপন করে, স্ত্রীর সাথে খারাপ আচরণ করে বা অযথা স্ত্রীকে কষ্ট দেয়, মৃত্যু শয্যায় কষ্ট পাওয়া থেকে সেই নারীকেও কেউ রক্ষা করতে পারবে না । জীবনে করা ভুল এবং তার পরিণতি দেখাতেই মহাভারতে ভীষ্মকে শরশয্যায় রাখা হয়েছিলো ৫৮ দিন ধরে, এই শরশয্যা আসলে মানুষের জন্য একটি শিক্ষা বা বার্তা, যাতে তারা ভুল না করে এবং জীবনের শেষ প্রান্তে এসে শয্যাশায়ী হয়ে তীর বিদ্ধ ভীষ্মের মতো কষ্ট না পায় ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top