মহাভারতে চক্রব্যূহ | যুদ্ধক্ষেত্রের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ফাঁদ

0
মহাভারতে চক্রব্যূহ | যুদ্ধক্ষেত্রের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ফাঁদ

মহাভারতে চক্রব্যূহ: যুদ্ধক্ষেত্রের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ফাঁদ

মহাভারত, ভারতীয় সাহিত্যের অমর মহাকাব্য, শুধু দেবতা ও মানবের কাহিনি নয়, এটি যুদ্ধনীতি, ন্যায়-অন্যায়, এবং মানবিক বীরত্বেরও এক অনুপম নথি । এর অন্যতম বিখ্যাত সামরিক কৌশল হল চক্রব্যূহ । একটি অত্যন্ত জটিল ও শক্তিশালী যুদ্ধবিন্যাস, যার কেন্দ্রস্থলে রয়েছে এক হৃদয়বিদারক আখ্যান । অর্জুনপুত্র অভিমন্যুর বীরত্ব ও আত্মত্যাগ ।

এই প্রবন্ধে আমরা অন্বেষণ করবো চক্রব্যূহের প্রকৃতি, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে তার ভূমিকা, এবং কীভাবে এক কিশোর বীর তার প্রাণ উৎসর্গ করে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে রয়েছেন ।

চক্রব্যূহ কী?

চক্রব্যূহ (বা পদ্মব্যূহ) হলো এক বিশেষ সামরিক বিন্যাস, যেখানে সৈন্যরা একাধিক স্তরে বৃত্তাকারভাবে সাজানো থাকে, ঠিক যেন একটি আবর্তমান চাকা বা প্রস্ফুটিত পদ্ম । সৈন্যদের অবিরাম গতি ও গতিশীল গঠন শত্রুকে বিভ্রান্ত করে ফেলে । কোথা থেকে প্রবেশ করবে কিংবা কিভাবে ভেদ করবে তা বোঝা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় ।

চক্রব্যূহে প্রবেশ করা যতটা কঠিন, তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা তারচেয়েও কঠিন । এ কৌশলের পূর্ণ রহস্য কেবল কয়েকজন নির্বাচিত যোদ্ধাই জানতেন, যেমন অর্জুন ।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে চক্রব্যূহের ব্যবহার

মহাভারতের ১৩তম দিনে, কৌরব সেনাপতি দ্রোণাচার্য চক্রব্যূহ নির্মাণ করেন । উদ্দেশ্য ছিল পাণ্ডবরাজ যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করা । কারণ যুধিষ্ঠির বন্দী হলে, যুদ্ধ পাণ্ডবদের জন্য প্রায় হারিয়ে যাওয়া নিশ্চিত ছিল ।
কিন্তু যুদ্ধে চক্রব্যূহ ভেদ করতে পারতেন একমাত্র অর্জুন । আর সে দিন অর্জুন ও কৃষ্ণকে কৌশলে যুদ্ধক্ষেত্রের দূর প্রান্তে ব্যস্ত রাখা হয়, ফলে পাণ্ডবরা বিশাল বিপদের মুখে পড়ে ।

অভিমন্যু: একাকী এক বীরের সংগ্রাম

অর্জুনের অনুপস্থিতিতে, তরুণ অভিমন্যু । মাত্র ষোলো বছরের এক অপরাজেয় সাহসী চক্রব্যূহে প্রবেশের দায়িত্ব নেন । যদিও তিনি সম্পূর্ণ কৌশল জানতেন না ।

মহাভারতের বর্ণনায় পাওয়া যায়, মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় অভিমন্যু তাঁর পিতা অর্জুনের মুখে চক্রব্যূহ ভেদ করার কৌশল শুনেছিলেন । কিন্তু যখন অর্জুন বের হওয়ার পদ্ধতি ব্যাখ্যা করছিলেন, তখন তাঁর মা সুভদ্রা নিদ্রামগ্ন হয়ে পড়েন । ফলে অভিমন্যু জানতেন কেবল প্রবেশের উপায়, বেরোনোর নয় ।

তবুও অভিমন্যু আত্মত্যাগের মহতী মনোভাব নিয়ে চক্রব্যূহে প্রবেশ করেন । তাঁর কাকা ভীম, সহদেব, নকুল এবং যুধিষ্ঠির বাধা দিলেও পরিস্থিতির চাপে তাদের সম্মতি দিতে হয় ।

চক্রব্যূহের অভ্যন্তরে যুদ্ধ

চক্রব্যূহ ভেদ করে অভিমন্যু প্রবেশ করেন এবং একের পর এক কৌরব সেনাপতিকে পরাজিত করেন । তিনি দুর্যোধনের পুত্র লক্ষ্মণকেও বধ করেন ।

কিন্তু ক্রমে চক্রব্যূহের গভীরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে, তিনি একাই ঘিরে পড়েন কৌরবদের প্রধান যোদ্ধাদের দ্বারা । দ্রোণ, কর্ণ, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা, দুঃশাসন, এবং কৃতবর্মার মতো মহাবীরেরা যুদ্ধের নিয়ম লঙ্ঘন করে একযোগে অভিমন্যুর ওপর আক্রমণ করেন ।

এটি ছিল সম্পূর্ণরূপে অনৈতিক । প্রাচীন । প্রাচীন ভারতীয় যুদ্ধনীতিতে একাধিক যোদ্ধা মিলে একটিমাত্র যোদ্ধাকে আক্রমণ করা নিষিদ্ধ ছিল ।

অভিমন্যুর মহামৃত্যু

অস্ত্রহীন হয়েও অভিমন্যু যুদ্ধ চালিয়ে যান । তাঁর ধনুক ভেঙে যায়, রথ ধ্বংস হয়, তরবারি কেড়ে নেওয়া হয় । শেষ পর্যন্ত, তিনি রথের চক্র তুলে তা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন ।

কিন্তু অসংখ্য মহাযোদ্ধার সম্মিলিত আক্রমণের সামনে, সেই কিশোর বীরও শেষপর্যন্ত পরাজিত হন । নির্মমভাবে তাঁকে হত্যা করা হয় । এটি কেবল এক যুদ্ধের পরাজয় ছিল না, বরং ন্যায়নীতিরও চরম অবমাননা ।

অর্জুনের প্রতিজ্ঞা ও প্রতিশোধ

অভিমন্যুর মৃত্যু অর্জুনের হৃদয়ে আগুন জ্বেলে দেয় । তিনি প্রতিজ্ঞা করেন । যদি পরের দিন সূর্যাস্তের আগে অভিমন্যুর হত্যাকারী জয়দ্রথকে বধ করতে না পারেন, তবে তিনি নিজেই অগ্নিতে প্রবেশ করে আত্মাহুতি দেবেন ।

১৪ তম দিনে অর্জুন অসম্ভব সাহস ও কৌশলে যুদ্ধ করে, অবশেষে সূর্যাস্তের ঠিক আগে জয়দ্রথকে হত্যা করে প্রতিজ্ঞা পালন করেন ।

চক্রব্যূহের প্রতীকী ব্যাখ্যা

চক্রব্যূহ শুধুমাত্র সামরিক কৌশল নয়, এটি জীবনের জটিলতারও প্রতীক । জীবন অনেক সময় এমন পরিস্থিতি তৈরি করে, যেখানে প্রবেশ সহজ হলেও, বেরিয়ে আসা অত্যন্ত কঠিন ।

অভিমন্যুর কাহিনি আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে অসম্পূর্ণ জ্ঞানও সাহসআত্মত্যাগের মাধ্যমে ইতিহাসে অমর স্থান করে নিতে পারেতার মৃত্যু কেবল যুদ্ধনীতির পতনকেই নয়, কৌরবদের অনিবার্য পতনের সূত্রপাতকেও নির্দেশ করে

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
Post a Comment (0)
To Top