অ্যাপোলো - সৌন্দর্যের আড়ালে এক মানবিক দেবতার গল্প

0

অ্যাপোলো - সৌন্দর্যের আড়ালে এক মানবিক দেবতার গল্প
Apollo

অ্যাপোলো: সৌন্দর্য ও শিল্পকলার গ্রিক দেবতা

অ্যাপোলোর অপর নাম ফিবাস । অলিম্পিয়ান দেবতাদের মধ্যে অ্যাপোলো ছিলেন সবচেয়ে সুদর্শন এবং সকলের প্রিয়। অনেক সময় তিনি হেলিওস-এর সঙ্গে একীভূত হয়ে সূর্যরূপে পূজিত হন এবং তাঁর বোন সেলেনে-কে বলা হয় চন্দ্র ।


জন্ম ও শৈশব

অ্যাপোলোর জন্ম হয় লেটো-র গর্ভে ডিলোস দ্বীপে । কিন্তু লেটো গর্ভবতী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হেরা জানতে পারেন এবং তাঁর ভয়ঙ্কর রোষ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য তিনি ডিলোস দ্বীপে পালিয়ে যান । এই ডিলোসেই তিনি এক যমজ সন্তান প্রসব করেন। এই যমজ সন্তানের মধ্যে একটি পুত্র ও অন্যটি কন্যা এরা হলেন যথাক্রমে অ্যাপোলো ও আর্টেমিস ।

আরো জানুনঃ আফ্রোদিতি - সৌন্দর্য, প্রেম এবং ট্র্যাজেডির গ্রিক দেবী

তবু প্রতিশোধ হলো না প্রতিহিংসাপরায়ণ হেরার রোষ । ফলে আপন সন্তানকে কোলে নিয়ে প্রকাশ্যে তাকে লালন করতে পারলেন না লেটো । তাই তিনি এ কাজের ভার দেন থেমিস-এর উপর । থেমিসের হাতে ভালোভাবেই বেড়ে উঠতে লাগলেন অ্যাপোলো । একদিন অ্যাপোলোর ছেলেবেলায় অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে । একমুঠো দেবভোগ্য অমৃত আস্বাদন করার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ যৌবন প্রাপ্ত হন অ্যাপোলো । তিনি তাঁর প্রিয় দুটি বস্তু অর্থাৎ এক হাতে একটি বীণা (কিথারা) আর এক হাতে একটি ধনুক-বাণ নিয়ে ঘুরতে ভালোবাসেন । অ্যাপোলোর ডান-বাঁ হাতে তাই সব সময় এই দুটি বস্তুই দেখা যায় ।


অ্যাপোলোর কীর্তি ও ক্ষমতা

অ্যাপোলোর প্রথম কৃতিত্ব হলো বিরাটকায় দৈত্য পাইথনকে হত্যা করা । তাঁর আর একটি বড় কাজ হলো ডেলফি-তে এক দেববাণীর মন্দির গড়ে তোলা । তাই অ্যাপোলোকে দৈববাণীর দেবতাও বলা হয় । স্বর্গ থেকে মর্ত্যলোকে যে সব আকাশবাণী শোনা যায় অ্যাপোলোই তা ব্যবস্থা করে থাকেন ।

এ ছাড়া অ্যাপোলো হলেন সকল প্রাণের ঔষধরূপ এবং রোগনিরাময়েরও দেবতা । তাঁর পুত্র আস্ক্লেপিয়াস-এর মধ্যে এই দুটি গুণের বেশি পরিচয় পাওয়া যায় । আসক্লেপিয়াসকে ওষধি ও চিকিৎসাবিদ্যার আবিষ্কারক দেবতাও বলা হয় । তিনিই এই শাস্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা । কিন্তু একবার আসক্লেপিয়াস এক মৃত ব্যক্তিকে পুনরুত্থিত করতে গেলে তাঁর ঔদ্ধত্যের জন্য জিউস তাঁকে হত্যা করেন । মৃতকে সঞ্জীবিত করার ক্ষমতা একমাত্র জিউসের । আসক্লেপিয়াস মৃত্যুর আগে তাঁর প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসাবিদ্যার ভার কন্যা হাইজিয়া-সহ শিষ্যদের হাতে দিয়ে যান ।

সর্বদেবতা অ্যাপোলোর শুধু রোগনিরাময়ের ক্ষমতা নেই, মহামারী বা মারাত্মক রোগ সৃষ্টির ক্ষমতাও তাঁর অসাধারণ । তাঁর রথ প্রায়ই রাজহাঁস দ্বারা টানা বলে বর্ণিত (সূর্যরথ ঘোড়ায় টানা--- ওটা হেলিওসের) । ইলিয়াড-এও দেখা যায়, তিনি এক তীরক্ষেপে শিবিরে মহামারী ডেকে আনতে পারেন । মানবসভ্যতার ইতিহাসে আজও যত সব শিল্পকলার উদ্ভব হয়েছে অ্যাপোলো তারও অধিষ্ঠাতা দেবতা ।


সংগীত ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক

গ্রিক অ্যাপোলোর সবচেয়ে বড় দান হলো সংগীত । সর্বশ্রেষ্ঠ গায়ক ও বীণাবাদক অর্ফিয়াস-কে অনেক কাহিনিতে তাঁরই পুত্র বলা হয় ।

অ্যাপোলো - সৌন্দর্যের আড়ালে এক মানবিক দেবতার গল্প

অ্যাপোলোর অধীনে ছিল শিল্পকলার ৯টি বিভাগের ৯ জন অধিষ্ঠাত্রী দেবী মিউজরা । তাঁরা হলেনঃ

এই সব দেবীদের প্রিয় মিলনস্থান হলো মাউন্ট হেলিকন আর পারনাসাস পাহাড়, আর সেই সংলগ্ন কাসটালিয়া ঝর্ণা । এই ঝর্ণার জলে যত সব কবি ও শিল্পীরা স্নান করে তাঁদের আরাধ্য দেবতা ফিবাসের উপাসনা করে ।


কলোসাস ও অন্যান্য মূর্তিকল্প

পিণ্ডারের বিবরণ থেকে জানা যায়, দেবতারা পৃথিবীকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করলে অ্যাপোলো ডেলফিতে তাঁর পবিত্র স্থান স্থাপন করেন । তবে যে বিখ্যাত “কলোসাস” মূর্তির কথা প্রচলিত, সেটি রোডসের কলোসাস । এটি সূর্যদেব হেলিওস-এর বিশাল প্রতিমূর্তি, অ্যাপোলোর নয়; ভূমিকম্পে তা ধ্বংস হয়ে যায় ।

যে সব শিল্পী ও ভাস্কররা অ্যাপোলোর ভক্ত তারা প্রায়ই এক বিশেষ মূর্তিতে তাঁকে মূর্ত করে তোলে । অপূর্ব যৌবনশ্রীসম্পন্ন, সম্পূর্ণ নগ্ন, মাথায় লরেল পাতার মুকুট । সূর্য দেবতা, শিল্পকলার দেবতা, চিরযুবক, চিরসুন্দর অ্যাপোলোর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ পরিচয় হলো তিনি মানবের গুণাবলি ধারণকারী দেবতা ।


মানবিক গুণ ও প্রেম

প্রেমিক, মার্জিত রুচিসম্পন্ন ভক্তদের প্রতি বিশেষভাবে অনুগ্রহশীল তিনি । সমগ্রভাবে গ্রীকধর্ম ও গ্রীক পুরাণের একটি দিককে নিঃসন্দেহে উজ্জ্বল ও গৌরবময় করে তুলেছেন একা অ্যাপোলো ।

মানুষের মত ভাল–মন্দ দুটি গুণই ছিল অ্যাপোলোর চরিত্রে । একবার তিনি হায়াসিন্থ নামে এক মর্ত্যবালককে গভীরভাবে ভালবাসতে থাকেন । তিনি তার সঙ্গে শিশুর মত খেলতেন । একদিন এভাবে খেলতে খেলতে ঘটনাক্রমে ডিস্কাসের আঘাতে মৃত্যুমুখে পতিত হয় হায়াসিন্থ । সে মৃত্যুতে শোকে দুঃখে একেবারে ভেঙ্গে পড়েন অ্যাপোলো! এক অপ্রতিরোধ্য বেদনায় মরণশীল মানুষের মত । কিন্তু হায়াসিন্থের নামকে চিরদিন মর্ত্যে অমর করে রাখার জন্য তার মৃত্যুর সময় যে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, সেই রক্ত থেকে এক নীল ফুলের জন্ম দেন তিনি ।

আর ডাফনে নামে এক জলপরীকে ভালবাসেন অ্যাপোলো। স্বর্গের দেবতার আকস্মিক ভালবাসায় কোন মানবী বা অর্ধদেবী কখনো সুখী হতে পারে না, এই ভেবে ডাফনে পালাতে চায় । পালিয়েও যায়; তবে ধরা পড়ার আগেই সে লরেল গাছে রূপান্তরিত হয় । এরপর অ্যাপোলো তাকে দান করেন চিরসবুজ পাতা । যার রং ম্লান হবে না কোনদিন ।

অন্যান্য দেবতারা তাঁদের ক্ষণপ্রণয়িণীদের উপর যে ব্যবহারই করুন না কেন, ডাফনের প্রতি অ্যাপোলোর আচরণটা ছিল সত্যিই বীরের মত মর্যাদাসম্পন্ন । কিন্তু তাঁর প্রেমিকা করোনিস-এর সঙ্গে আচরণটা ন্যায়সঙ্গত হয়নি; সেটা ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতায় পর্যবসিত হয় । একবার এক কাক (র‍্যাভেন) সহসা করোনিস সম্পর্কে কুৎসা রটায়; এ কথা শুনে অ্যাপোলো ক্রোধান্ধ হয়ে করোনিসকে হত্যা করেন । তখন কাকের রং সাদা ছিল । এই ঘটনার পর অভিশাপে কাকের রং কালো করে দেন অ্যাপোলো । তবু যুগ যুগ ধরে অসংখ্য কবির দ্বারা কীর্তিত ও অসংখ্য শিল্পীর দ্বারা বিভিন্নভাবে চিত্রিত ও কথিত হয়ে আসছেন অ্যাপোলো ।


তথ্যসূত্র (References)

  1. Encyclopedia Britannica: "Apollo"
  2. Wikipedia: "Apollo"
  3. Greek Mythology
  4. Theoi Project
  5. Homer's Iliad and Odyssey

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
Post a Comment (0)
To Top