আদিগুরু শঙ্করাচার্যের জীবনী

0

আদিগুরু শঙ্করাচার্যের জীবনী

Table of Content (toc)

কে তব কান্তা আর কে তব কুমার ?

অতীব বিচিত্র এই মায়ার সংসার ।

কোথা হতে আসিয়াছ, তুমি বা কাহার,

ভাব করহ ভাই, এই তত্ত্ব সার ।

                              --- শ্রীশঙ্করাচার্য


শঙ্করাচার্যের জন্ম বৃত্তান্ত

শঙ্করাচার্যের আবির্ভাব এদেশের রাজনৈতিক জীবনের এক উল্লেখযােগ্য সময় । চারশ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে । হুনদের আক্রমণে দেশের স্বাভাবিক অবস্থা বিপর্যস্ত । ধর্মীয় জীবনেও বিপর্যয় নেমে এসেছে । জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে নানা কুসংস্কার প্রবেশ করেছে । হিন্দুধর্মের মহিমাও ম্লান হয়ে গেছে । এই যুগসন্ধিক্ষণে ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দের বৈশাখী শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে দাক্ষিণাত্যের কেরল রাজ্যের কালাড়ি গ্রামে শঙ্করাচার্য জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতা শিবগুরু ও মাতা সুভদ্রা । শিবগুরু শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ এবং শিবভক্ত ছিলেন । গ্রামে ছিল চন্দ্রমৌলীশ্বর শিবের মন্দির। সেই মন্দিরে স্বামী স্ত্রী প্রতি দিনই পুত্র সন্তানের জন্য প্রার্থনা করতেন । শিবের কৃপায় তারা এক পুত্র লাভ করেন । শিবের এক নাম শঙ্কর । তাই তারা পুত্রের নাম রাখলেন শঙ্কর ।


প্রতিভাবান শঙ্কর

শঙ্কর ছিলেন প্রতিভাবান । অসাধারণ স্মরণশক্তির অধিকারী তিনি ।

যা পাঠ করতেন তাই স্মরণ করে রাখতেন । কথিত আছে মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই উপনয়নের সময় তার বেদজ্ঞান সম্পন্ন হয় । তিনি সর্বশাস্ত্রে বিশারদ হয়ে উঠেন । শঙ্করের পাণ্ডিত্যের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল ।

সন্যাস গ্রহণ

এক দিন শঙ্করের জন্মকুণ্ডলী দেখে কয়েকজন পণ্ডিত বললেন, “বালক স্বল্পায়ু । ষােল বছর ও বত্রিশ বছরে জীবন হানির যােগ আছে ।” শঙ্কর তখন চিন্তা করলেন, এ ক্ষণস্থায়ী জীবন সংসার মায়ায় আবদ্ধ হয়ে লাভ কী ? তাঁর জীবনে সন্ন্যাস গ্রহণের চিন্তা এলো । তিনি মাকে জানালেন সে কথা । কিন্তু মা একমাত্র সন্তানকে কিছুতেই সংসার ত্যাগ করতে দিতে চান না । শঙ্কর মাকে বুঝালেন, “মাগাে, তােমায় কথা দিচ্ছি, সন্ন্যাস নিই আর যেখানে থাকি, তােমার অন্তিমকালে নিশ্চয়ই আমি তােমার কাছে উপস্থিত থাকব ।” ছেলের কথা শুনে মা আর বাধা দিলেন না । শঙ্কর সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য যাত্রা করলেন এবং মহাযােগী গােবিন্দপাদের শরণাপন্ন হলেন । গােবিন্দপাদ তাকে শিষ্যরূপে গ্রহণ করলেন । শঙ্কর গুরুর আশ্রমে তিন বৎসর সাধনা করে যােগসিদ্ধি ও তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেন ।


গুরু গােবিন্দপাদের আদেশে শঙ্কর চলে যান হিমালয়ের নিভৃত ধাম বদরিকা আশ্রমে । সেখানে তিনি বেদান্তভাষ্য পভতি গ্রন্থ রচনায় মনােনিবেশ করেন । ষােল বৎসর বয়সের মধ্যেই গুরুর নির্দেশিত গ্রন্থ রচনার কাজ সমাপ্ত করেন ।


ধর্মগুরু শঙ্করাচার্য

এর পর ধর্মগুরু হিসেবে শঙ্করের নতুন জীবন আরম্ভ হল । উত্তর ভারতের পুণ্যধাম বারাণসী তীর্থে তিনি ধর্ম প্রচারের কাজ শুরু করলেন । তার অগাধ পান্ডিত্য ও বাগ্মিতার কাছে স্থানীয় পণ্ডিত ও দার্শনিকদের পরাজয় ঘটল । সাধারণ মানুষের কাছে তিনি অদ্বৈতবাদের কথা তুলে ধরলেন—“পরম ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, বাকি সব মায়া ।"


অদ্বৈতবাদ প্রচার

জনশ্রুতি আছে যে একবার মহাদেবের সঙ্গে শঙ্করাচার্যের সাক্ষাৎ হয় । মহাদেব তাকে বলেন, “একেশ্বরবাদ প্রচার কর । তবে তার পূর্বে ধর্মশাত্রের নির্ভুল ব্যাখ্যা আলােচনা কর, যাতে মানুষ ধর্ম সাধনায় বিপথগামী না হয় । শঙ্করাচার্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে অদ্বৈতবাদ প্রচার করেন । জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই—এই মতই হল অদ্বৈতবাদ । শঙ্করাচার্য ভারতবর্ষের চার প্রান্তে চারটি মঠ স্থাপন করেন । দ্বারকায় সারদা মঠ, পুরীতে গােবর্ধন মঠ , জ্যোতিধামে (বদরিআশ্রমে) যােশী মঠ এবং রামেশ্বরে শৃঙ্গেরি মঠ ।

আরও পড়ুন  : ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সম্পূর্ণ জীবনী


মাতৃবিয়োগ

এক দিন শৃঙ্গেরি মঠে বসে শঙ্করাচার্য অধ্যাপনায় রত । হঠাৎ তিনি অনুভব করলেন তার মা তাকে ডাকছেন । তিনি গৃহত্যাগ করার সময় মাকে কথা দিয়েছিলেন, তাঁর অন্তিমকালে উপস্থিত থাকবেন । মায়ের সেই অন্তিমকালের আহ্বান শঙ্করাচার্য শুনতে পেলেন । দ্রুত যাত্রা করলেন কালাড়ি অভিমুখে, মায়ের সন্নিকটে । সন্ন্যাসী শঙ্করাচার্য মায়ের অন্তিম সময়ে পাশে বসে ভগবানের স্তব করতে লাগলেন । মায়ের আনন্দাশু নির্গত হতে লাগল । পরমানন্দ লাভ করে শঙ্করের জননী ইহধাম ত্যাগ করলেন ।


মৃত্যুবরণ

এবারে হিমালয়ের হাতছানি অনুভব করলেন শঙ্কর । তিনি হিমালয় অভিযানে যাত্রা শুরু করলেন । উত্তরাখণ্ডের কেদারনাথ ধামই তার গন্তব্য স্থান । শঙ্করের বয়স তখন ৩২ বছর । এই কেদারনাথে মহাসমাধিতে তিনি দেহত্যাগ করেন ।

মাত্র ৩২ বছর তিনি জীবিত ছিলেন শঙ্করাচার্য । এই স্বল্প সময়ে তিনি ব্রহ্মসূত্র ও প্রধান উপনিষদগুলাের ভাষ্য, মােহমুদৃগর, আনন্দলহরি, শিবস্তব, গােবিন্দাষ্টক প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন । যেগুলি আজ আমাদের মাঝে না থাকলে আমরা ধর্মীয় গোড়ামী তথা অন্ধকারেই থেকে যেতাম ।

নিচে আদিগুরু শঙ্করাচার্যের কয়েকটি উক্তি উল্লেখ করা হলো :


১. পদ্মপত্রে বারিবিন্দু যেমন চঞ্চল,

জীবন তেমন হয় অতীব চপল ।

জানিও, করেছে গ্রাস ব্যাধি বিষধর,

সমস্ত সংসার তাই শোকে জরজর ।


২. দিবস, যামিনী, আর সায়াহ্ন প্রভাত,

শিশির, বসন্ত পুনঃ করে যাতায়াত ।

 এই রূপে খেলে কাল ক্ষয় পায় আয়ু;

তথাপি মানব নাহি ছাড়ে আশা-বায়ু ।


৩. যতদিন করে নর ধন উপার্জন

ততদিন থাকে বশে নিজ পরিজন ।

পরে যবে বৃদ্ধ কালে জীর্ণ হয় দেহ,

ডেকেও জিজ্ঞাসা ঘরে নাহি করে কেহ ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top