হিন্দুরা কেন মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলে ?

0
হিন্দুরা কেন মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলে ?


হিন্দুরা কেন মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলে

এটাকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সৎকার, শেষকৃত্য, অন্তিম অনুষ্ঠান, চরম সংস্কার, পঞ্চত্ব প্রাপ্তি সংস্কার বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও বলে থাকেন । যে দেহের প্রতি মানুষের অত টান, মায়া তাকে মৃত্যুর পর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ফেলা হবে এ কেমন নিষ্ঠুর মনমানসিকতা । পূর্বেই বলা হয়েছে সনাতন ধর্মীয় দিক-দর্শন, সংস্কৃতি খুবই উচ্চ মাগীয় চিন্তাধারা । অতি সাধারণ বা স্বল্প জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ মৃত্যু-উত্তর দাহ ব্যবস্থাকে খুবই মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক মনে করে থাকেন । মানুষ মারা গেলে স্বাভাবিকভাবেই এক-দুই দিন পর মৃতদেহে পঁচন শুরু হয়, এত মায়ার শরীরের পঁচা গন্ধে আশে-পাশে নিকট আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশী কেহই বসবাস করার যাে নেই। তাই মৃতদেহকে সৎকার করতে হয় ।

মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলার ধর্মীয় কারণ

বাস্তবিকপক্ষে এ দেহে যতক্ষন পর্যন্ত প্রাণবায়ু- অর্থাৎ আত্মা রয়েছে ততক্ষন পর্যন্ত এর সজীবতা ও গুরুত্ব রয়েছে, কিন্তু মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা পর এর আর কোন মূল্য নেই । এ প্রসঙ্গে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মৃতদেহকে জীর্ণ বস্ত্রের সাথে তুলনা করেছেন, উনি আত্মার গুরুত্ব, আত্মার সাথে পরমাত্মার সম্পর্ক ও সংযুক্তির কথা গীতায় দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১১ থেকে ৩০নং শ্লোকে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করেছেন ।

দেহিনােহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা ।

তথা দেহান্তরপ্রাপ্তিধীরস্তত্র ন মুহ্যতি ৷

বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়........সংযাতি নবানি দেহী';

নৈনং ছিন্দতি শস্ত্ৰানি...........ন শােষয়তি মারুত';

'অচ্ছেদ্যোহয়মদাহ্যো..........স্থানুরচললাহয়ং সনাতনঃ' ।

                                                            -- শ্রীমদ্ভগবদগীতা


মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র ত্যাগ করে অন্য নতুন বস্ত্র গ্রহণ করে, আত্মাও তেমনি জীর্ণ বস্ত্র অর্থাৎ মৃত দেহ ত্যাগ করে অন্য নতুন দেহ গ্রহণ করেন । এটাই প্রকৃতির চিরন্তন নিয়ম ও আবর্তন । তাই মৃতদেহকে নিয়ে শােক করার কিছুই নেই। রবিঠাকুর বলতেন, 'মরণরে তুহু মম শ্যাম সম- অর্থাৎ তুমি আমার কৃষ্ণের মত । সনাতন মানবধর্মীয় দর্শন ও সংস্কৃতিতে মৃত্যোত্তর মাটিতে দাপণকরা, সমাধি দেওয়া, দাহ করা প্রভৃতি ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। কতিপয় উন্নত দেশে মৃতদেহ সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে, এর মিউজিয়ামও রয়েছে । আত্মহত্যা, খুন, এক্সিডেন্ট, রহস্যজনক মৃত্যু এ সকল আইনগত জটিলতার ক্ষেত্রে সবরকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এটি আর সংরক্ষণের প্রয়ােজন হয়না । কারণ সংরক্ষণ করা অত্যধিক ব্যয় সাপেক্ষ ।

মিশর, ইউক্রেনসহ কয়েকটি দেশে মৃতদেহের মমি ও পিরামিড রয়েছে । সবরকমের সৎকার ব্যবস্থার আর্থ-সামাজিক ও প্রাকৃতিক Merits/ Demerits রয়েছে । সংক্ষেপে আমরা ব্যাখা দিচ্ছি- মৃতদেহ যদি জলে ভাসানাে হয়, মাছে খেয়ে ফেলে ঠিকই, কিন্তু তার পূর্বেই জল মারাত্মক ভাবে দূষিত হয়ে পড়ে, হাঁড়গােড় থেকেই যায় । মাটিতে যদি কোন মৃতদেহ সমাধি দেওয়া হয়, তা অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই পােকা-মাকড়ে খেয়ে ফেলে এবং মৃতদেহ হতে বিভিন্ন রকমের পােকামাকড়-জীবানু মাটিতে ও জন জীবনে ছড়ায়, পরিবেশ দূষিত হয় তাছাড়া হাড়গােড়গুলাে থেকেই যায়, ফলে জায়গাটি ব্যবহারের অনুপযােগী হয়ে পড়ে, মাটি ও ভূমির অপচয় হয় । এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, পূর্বেকার দিনে বসন্ত রােগে আক্রান্ত মৃত ব্যক্তিকে দাহ করা হত রােগ-জীবানু ছড়ানাের প্রকোপ হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য । বর্তমানে প্ল্যাগ, বার্ড ফ্লু, সােয়াইন ফ্লু, সার্চ, এনথাক্স ইত্যাদি রােগে আক্রান্ত ও মৃত পশু-পাখি-প্রাণীদের পুড়িয়ে ফেলা হয়। তাই এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা বলেন, পুড়িয়ে ফেলা অনেকাংশে নিরাপদ । 


এমনিতেই পৃথিবীতে বসবাসের উপযােগী ভূমি ও মাটির পরিমাণ । সীমিত এবং ক্রমান্নয়ে জনবিস্ফোরণে দিন দিন আরাে সীমিত হয়ে পড়ছে । এ প্রসংগে চীনা একটি প্রবাদ রয়েছে- 

'The Earth for living men not for dead men'

দাহ ব্যবস্থাটি আপাত দৃষ্টিতে খুব বেদনাদায়ক মনে হলেও বাস্তবিক পক্ষে মৃত দেহের কোন দাম নেই । দাহের সময় পরিবেশে একটু গন্ধ ছড়ায় এছাড়া কেহ এতে আর কোন মারাত্মক ক্ষতিকারক কিছুই পাননি । পূর্বে এর জ্বালানি সংগ্রহে কষ্ট হত; এখন আধুনিক ব্যবস্থায় চুল্লি (গ্যাস, বিদ্যুৎ) হওয়াতে একই চুলায় অগণিত দাহ করা যায়, মাটির ও গাছ-গাছালির অপচয় হয় না । অগ্নি দেবতা ও দেব পুরােহিত, প্রতিদিনই মানুষকে অগ্নি পূজা করতে হয়, অগ্নিতে দাহ হয়ে প্রায় সবকিছু শুদ্ধ হয়ে যায় । দাহ একধরণের যজ্ঞ । দাহকৃত মৃতদেহের ছাই জলের মাধ্যমে প্রকৃতিতে মিশে যায় এবং এর ধোঁয়া মেঘ বৃষ্টির মধ্যদিয়ে ধরাধামে ফিরে আসে যা শক্তির নিত্যতা সূত্রের মধ্যে পড়ে । অর্থাৎ প্রকৃতির মাল প্রকৃতিতে ফিরে আসে এবং পঞ্চভূতে (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম্) লয় প্রাপ্ত হয় আবার পুনরুত্থাণ হয় । চিতাতে মুখাগ্নি করার সময় ব্রাহ্মণ উক্ত বৈদিক মন্ত্রটি সহ আরাে মন্ত্র পাঠ করান-


ওঁ কৃত্বা তু দুস্কৃতং কর্ম জানতা বাপজানতা ।

মৃত্যুকালবশং প্রাপ্য নরং পঞ্চমাগতম ।

ধর্মাধর্মসমাযুক্তং লােভমােহসমাবৃত ।

দহেয়ং সর্বগাত্ৰানি দিব্যান লােকান্ স গচ্ছতু ॥

সনাতন মানবধর্মাবলম্বী মুনি-ঋষিগণ মানুষের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিয়ে বহু গবেষণার পর দাহ ব্যবস্থাকে সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ করেছেন যা ক্রমচলমান ।

আরও পড়ুন :

হিন্দু ধর্মের বিবাহ সম্পর্কিত কিছু তথ্য

আদ্যশ্রাদ্ধ কি ? এবং কেন করণীয় ?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top