বাংলায় রামায়ণের সারসংক্ষেপ

0

বাংলায় রামায়ণের সারসংক্ষেপ

Table Of Content (toc)

সম্পূর্ণ রামায়ণ বাংলা

হিন্দুধর্মে রামায়ণ একটি উল্লেখযোগ্য ধর্মগ্রন্থ । আদিকবি বাল্মীকি এর রচয়িতা। রামচন্দ্রের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমগ্র জীবন-কাহিনি এখানে রয়েছে । রামচন্দ্রের ধর্মনিষ্ঠা, সততা, বীরত্ব, ন্যায়পরায়ণতা, ত্যাগ, সংযম, গুরুভক্তি, প্রজাপ্রীতি প্রভৃতি গুণাবলি এই কাহিনিতে ফুটে উঠেছে । মূল কাহিনির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা উপকাহিনি ।

রামায়ণ সাতটি কাণ্ডে বিভক্ত- আদিকাণ্ড, অযোধ্যাকাণ্ড, অরণ্যকাণ্ড, কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড, সুন্দরকাণ্ড, যুদ্ধকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ড । সবগুলো কান্ড মিলে পাঁচশ সর্গ বা পরিচ্ছেদ রয়েছে। এই সর্গগুলোতে চব্বিশ হাজারের বেশি শ্লোক রয়েছে ।

রামায়ণের বিষয়বস্তু সংক্ষেপে তুলে ধরা হলোঃ

১. আদিকাণ্ড

ত্রেতাযুগে ভারতবর্ষে অযোধ্যা নামে এক নগরী ছিল । স্বর্গের রাজধানী অমরাবতীর সাথে তুলনীয় এই নগরী । - যুদ্ধ করে এ নগরীকে কেউ জয় করতে পারত না । তাই এর নাম অযোধ্যা । অযোধ্যার রাজা ছিলেন দশরথ । - তাঁর তিন রানি- কৌশল্যা, কৈকেয়ী ও সুমিত্রা । সন্তান কামনা করে রাজা দশরথ 'পুত্রেষ্টি' যজ্ঞ করেন । এরপর = কৌশল্যার গর্ভে রাম, কৈকেয়ীর গর্ভে ভরত এবং সুমিত্রার গর্ভে লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্নর জন্ম হয়। উপযুক্ত - শিক্ষা-দীক্ষায় তারা বড় হয়ে ওঠে। এদিকে বিশ্বামিত্র মুনির সিদ্ধাশ্রমে রাক্ষসেরা বড়ই উপদ্রব শুরু করে । এ থেকে বাঁচার জন্য তিনি রাম ও লক্ষ্মণ- কে সিদ্ধাশ্রমে নিয়ে আসেন। রামের হাতে তাড়কারাক্ষসী, তাড়াকাপুত্র মারিচ ও সুবাহু নিহত হয় ।

এরপর সকলে মিথিলায় আসেন । মিথিলার রাজা জনকের সীতা নামে একটি মেয়ে ছিল । জনকের ইচ্ছা, তাঁর প্রাসাদে থাকা হরধনুতে যিনি গুণ (রজ্জু) লাগাতে পারবেন, তাঁর সাথেই তিনি সীতার বিয়ে দেবেন । বিশ্বামিত্রের নির্দেশে রাম ধনুক হাতে তুলে নেন । তিনি ধনুকে এত জোরে টান মারেন যে ধনুক ভেঙে দুটুকরো হয়ে যায় । এরপর রামের সঙ্গে সীতার বিয়ে হয় । রাজা জনকের আরও এক মেয়ে ছিলো। তাদের মধ্যে লক্ষ্মণের সঙ্গে বিয়ে হয় উর্মিলার। জনকের ভাই ছিলেন কুশধ্বজ । তাঁর ছিল দুই মেয়ে মাণ্ডবী আর শ্রুতকীর্তি । শত্রুঘ্নের সঙ্গে বিয়ে হয় শ্রুতকীর্তির । ভরতের সাথে বিয়ে হয় মাণ্ডবীর। বিয়ের পর অযোধ্যায় ফেরার পথে রামের পথ আটকে দেন পরশুরাম । তিনি শুনলেন-রাম 'হরধনু' তথা শিবের নামের ধনুক ভেঙে ফেলেছেন। পরশুরাম ছিলেন শিবভক্ত । তিনি মনে করলেন রাম হরধনু ভেঙ্গে শিবকে অপমান করেছেন। তবে রামের সাথে সুমধুর যুক্তিপূর্ণ কথায় পরশুরাম শান্ত হন ।

২. অযোধ্যাকাণ্ড

অযোধ্যায় দশরথের বড় ছেলে রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেকের আয়োজন শুরু হয় । আত্মীয়-স্বজন, মুনি-ঋষিরা উৎসবে যোগ দেন। সবার মনে আনন্দ আর ধরে না । কিন্তু রানি কৈকেয়ীর দাসী মন্থরার মনে আনন্দ নেই । কৈকেয়ীর কাছে গিয়ে সে বলে, 'রাম রাজা হলে তোমার নিজের ছেলে ভরতের কী হবে? ভরতকে রামের দাস হয়েই থাকতে হবে । অসুস্থ রাজা দশরথকে যখন তুমি সেবাযত্ন করেছিলে, তখন রাজা তোমাকে দুটি বর দিতে চেয়েছিলেন । সেই বর চেয়ে ভরতকে রাজা করার আজই সুযোগ।' মন্থরার কুমন্ত্রণায় কৈকেয়ী রাজা দশরথের নিকট গেলেন। তিনি রাজা দশরথকে তাঁর পূর্বে তাঁকে দেয়া বরের কথা মনে করিয়ে দিলেন । এবার তিনি রাজার নিকট তাঁর প্রতিশ্রুত বর চেয়ে বলেন-

'এক বরে ভরতেরে দেহ সিংহাসন।
আর বরে শ্রীরামেরে পাঠাও কানন।।
চতুর্দশ বৎসর থাকুক রাম বনে।
ততকাল ভরত বসুক সিংহাসনে।।'

এ কথা শুনে রাজা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন । সবকিছু শুনে রাম পিতৃসত্য পালনের জন্য বনবাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন । সহধর্মিণী সীতা ও ভাই লক্ষ্মণও তাঁর সঙ্গে যান । অযোধ্যাবাসী কাঁদতে কাঁদতে তাঁদের বিদায় জানায় । পুত্রশোকে দশরথের মৃত্যু হয়। এসময় ভরত ছিলেন তাঁর মামার বাড়িতে । তিনি প্রাসাদে এসে সবকিছু শুনে বেশ মর্মাহত হন এবং বনে গিয়ে রামের সঙ্গে দেখা করেন । অনেক কাকুতি-মিনতি করে রামকে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন । কিন্তু ব্যর্থ হয়ে রামের পাদুকা নিয়ে ফিরে আসেন । সিংহাসনের ওপর পাদুকা রেখে রামের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি রাজ্য পরিচালনা শুরু করেন ।

৩. অরণ্যকাণ্ড

বনবাসের সময়ে রাম-লক্ষ্মণের হাতে বিরাধ রাক্ষস নিহত হয় । ঋষি অগস্ত্য রামচন্দ্রকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র উপহার দেন । পঞ্চবটী বনে বসবাসের সময় রাবণের বোন শূর্পণখা রাম ও লক্ষ্মণকে প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয় । লক্ষ্মণের হাতে শূর্পণখার নাক-কান কাটা যায় । রাক্ষসেরা রাম-লক্ষ্মণকে আক্রমণ করলে রামের হাতে চৌদ্দ হাজার চৌদ্দ জন রাক্ষসসহ খর, দূষণ ও ত্রিমূর্ধা রাক্ষস নিহত হয় । বোনের অপমানের প্রতিশোধ নিতে রাবণ সীতাকে অপহরণ করে লঙ্কায় নিয়ে যান । জটায়ু-পক্ষী বাধা দিলে রাবণের খঙ্গের আঘাতে তাঁর পাখা কাটা যায় । রাম-লক্ষ্মণকে সীতার অপহরণের সংবাদ জানিয়ে জটায়ুর মৃত্যু হয় ।

৪. কিষ্কিন্ধ্যাকান্ড

সীতাকে খুঁজতে খুঁজতে রাম-লক্ষ্মণ ঋষ্যমুক পর্বতের কাছে পৌঁছান । সেখানে বানররাজ সুগ্রীবের সঙ্গে রামের অগ্নিসাক্ষী করে বন্ধুত্ব স্থাপিত হয় । সুগ্রীব ও বালী দুই ভাই । বালী ছিলেন কিষ্কিন্ধ্যার রাজা । একদা অসুর বধ করতে গিয়ে বালী আর ফিরে আসছিলেন না । সবাই ভাবল বালী নিশ্চিই মারা গিয়েছেন । তাই বালীর ভাই - সুগ্রীব কিষ্কিন্ধ্যার সিংহাসনে বসেন । বালী ফিরে এসে সুগ্রীবকে অত্যাচার করে তাড়িয়ে দেন। মৃত্যুভয়ে সুগ্রীব - তখন ঋষ্যমুক পর্বতে বসবাস করছিলেন। ঋষির অভিশাপের ভয়ে বালী এই পর্বতে প্রবেশ করতেন না । রামের পরামর্শে সুগ্রীব বালীকে যুদ্ধে আহ্বান করেন । রাম দূর থেকে বাণ নিক্ষেপ করে বালীকে হত্যা করেন। সুগ্রীবকে কিষ্কিন্ধ্যার রাজা ঘোষণা করা হয় । এবার সুগ্রীবের নির্দেশে বানরেরা দিকে দিকে রওনা দেয়। খবর চাই- কোথায় সীতা? হনুমান, জাম্বুবান প্রমুখরা বিন্ধ্যপর্বতে পৌঁছালে সম্পাতি-পক্ষীর সঙ্গে তাঁদের দেখা হয় । সম্পাতি জানান- লঙ্কার রাজা রাবণ সীতাকে আকাশপথে লঙ্কায় নিয়ে গেছে । এ কথা শুনে মহাবীর হনুমান লাফ দিয়ে সাগর পার হওয়ার উদ্দেশ্যে মহেন্দ্র পর্বতের চূড়ায় ওঠেন ।

৫. সুন্দরকাণ্ড

নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে হনুমান একসময় লঙ্কায় পৌঁছান । খুঁজতে খুঁজতে রাবণের অশোকবনে সীতার সঙ্গে তাঁর দেখা হয় । এরপর হনুমান অশোকবন ধ্বংস করতে শুরু করেন । রাবণপুত্র ইন্দ্রজিৎ এসে হনুমানকে ব্রহ্মজাল-বাণে বন্দি করে রাবণের কাছে নিয়ে আসেন । শায়েস্তা করার জন্য হনুমানের লেজে কাপড়-চোপড়, তেল-ঘি মেখে আগুন দেওয়া হয় । হনুমান তখন লাফিয়ে লাফিয়ে প্রাসাদে প্রাসাদে আগুন লাগাতে শুরু করেন । ফলে সারা লঙ্কায় আগুন ছড়িয়ে পরে । ফিরে এসে হনুমান রামের কাছে সব খবর জানান ।

৬. যুদ্ধকাণ্ড

সাগর পাড়ি দিয়ে লঙ্কায় যাওয়ার জন্য সাগরের ওপর ভাসমান সেতু নির্মাণ করা হয় । রাম-লক্ষ্মণসহ বানরেরা দলে দলে লঙ্কায় যায় । এদিকে রাবণের ভাই ধার্মিক বিভীষণ রামের চরণে শরণ নেন। অতঃপর দুই পক্ষের মধ্যে মহাযুদ্ধ শুরু হলো। রাবণের ছোট ভাই কুম্ভকর্ণ টানা ছয় মাস ঘুমান এবং এক দিন মাত্র জেগে থাকেন। এরপর আবার ঘুমিয়ে পড়েন। দেশে যুদ্ধ বাঁধলে রাবণের নির্দেশে অসময়ে তাঁর ঘুম ভাঙিয়ে যুদ্ধে নিয়ে আসা হয় । কিন্তু যুদ্ধে রামের ঐন্দ্রবাণে কুম্ভকর্ণের মৃত্যু হয় । লক্ষ্মণের ঐন্দ্রবাণে রাবণপুত্র ইন্দ্রজিৎ মারা যান । রাবণের শক্তি-অস্ত্রের আঘাতে লক্ষ্মণ অজ্ঞান হয়ে যান । হনুমান বিশল্যকরণী ওষুধ আনতে হিমালয়ে আসেন । কিন্তু বৃক্ষ চিনতে না পেরে হনুমান গোটা পর্বতশৃঙ্গই তুলে নিয়ে আসেন। ওষুধির প্রয়োগে লক্ষ্মণ সুস্থ হয়ে ওঠেন ।

রামচন্দ্র ধনুকে ব্রহ্মাস্ত্র জোড়েন । আকাশ-পাতাল কাঁপতে শুরু করে । ব্রহ্মাস্ত্রের আঘাতে লঙ্কার রাজা রাবণের মৃত্যু হয়। যুদ্ধশেষে রাবণের ভাই বিভীষণকে লঙ্কার রাজা করা হয় । এবার যাঁকে উদ্ধারের জন্য আয়োজন, সেই সীতাকে রামের কাছে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু সীতাকে দেখে রামচন্দ্রের কোনো অতিরিক্ত আবেগ বা উচ্ছ্বাস প্রকাশ পেল না । কারণ একদিকে তিনি যেমন স্বামী, অন্য দিকে দেশের রাজাও । রামের এ অবজ্ঞা সীতা মেনে নিলেন না । তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন অগ্নিতে প্রাণ বিসর্জন দিবেন । কিন্তু মূর্তিমান অগ্নিদেব প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ড থেকে সীতাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসেন । শেষে পুষ্পক রথে চড়ে সবাই অযোধ্যার পথে রওনা দেন । অযোধ্যায় রামের রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন হয় ।

৭. উত্তরকাণ্ড

এদিকে অযোধ্যায় প্রজাদের মধ্যে একটি জনরব সৃষ্টি হয়। সীতা রাবণের লঙ্কায় বাস করেছেন । তাঁর চারিত্রিক শুদ্ধতা নষ্ট হয়েছে। রাজা রামচন্দ্র প্রজাদের খুশি করার জন্য সীতাকে বনবাসে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। রামের নির্দেশে লক্ষ্মণ গর্ভবতী সীতাকে মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রমে রেখে আসেন । সেখানে সীতার কুশ ও লব নামে দুই পুত্রের জন্ম হয় ।

এরপর বারো বছর কেটে গেছে। রাজা রামচন্দ্র অশ্বমেধ যজ্ঞ শুরু করেন । ঋষি বাল্মীকি কুশ-লবকে সঙ্গে নিয়ে যজ্ঞে উপস্থিত হন। সীতাকে গ্রহণ করার জন্য তিনি রামকে অনুরোধ করেন । কিন্তু উপস্থিত প্রজারা তখনো নিরুত্তর। তখন রাম আবারও সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে বলেন । সীতা অসম্ভব অপমানিত বোধ করেন। তিনি ধরণীদেবীকে অনুরোধ করলে মাটি দুইভাগ হয়ে যায়। সেখান থেকে এক নাগবাহী সিংহাসন উঠে আসে। সীতাদেবী সিংহাসনে বসে পাতালে প্রবেশ করেন ।

অতঃপর মহাকালের নির্দেশে রামচন্দ্র একদিন লক্ষ্মণকে বর্জন করেন। সরযু নদীর কূলে গিয়ে লক্ষ্মণ যোগবলে দেহত্যাগ করেন । কিছুদিন পর রামচন্দ্রও দেহত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে সরযু নদীর কূলে আসেন । স্বজনেরা তাঁর অনুগামী হন । রামচন্দ্র জলে নামার পর সেখানে ব্রহ্মার আগমন ঘটে। ব্রহ্মার অনুরোধে রাম বিষ্ণুর তেজে প্রবেশ করেন । অনুগামীরাও নদীর জলে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে দিব্যলোক প্রাপ্ত হন ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top