বাংলাদেশে দেবোত্তর সম্পত্তি: দখল, দুর্নীতি ও হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্দশা

0
বাংলাদেশে দেবোত্তর সম্পত্তি: দখল, দুর্নীতি ও হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্দশা
ঢাকেশ্বরী মন্দির

হিন্দুদের দেবোত্তর সম্পত্তি হস্তান্তর বা বিক্রি করার কোনো নিয়ম নেই । নেই কোনো আইন, বরং এই সম্পত্তি হস্তান্তর বা বিক্রি করার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে । তবুও এক শ্রেণির লোক, অধিকাংশ ক্ষেত্রে যারা প্রভাবশালী, এই আইনকে অমান্য করে হিন্দুদের দেবোত্তর সম্পত্তি দখল করে নিচ্ছে । দখল করার আগে অথবা পরে ভূয়া দলিল প্রদর্শন করে এই দখলদার গোষ্ঠী । দেশে যে সরকার যখন ক্ষমতায় এসেছে সে সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট একটি চক্র এই সম্পত্তি দখল করেছে সবচেয়ে বেশি । বলাবাহুল্য, দখলের এই অত্যাচার অব্যাহত রয়েছে দেশের প্রতিটি জেলায়

আজকে আমি সালাম আজাদ কর্তৃক কালেক্টেড তথ্য থেকে কিছু লেখা শেয়ার করলাম । এগুলো ভদ্রলোক ৯০ দশকে বিভিন্ন জায়গায় সরেজমিনে গিয়ে ও বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত আর্টিকেল থেকে সংরক্ষণ করেন । বর্তমানেও বহু দেবোত্তর সম্পত্তি দখল হয়ে যাচ্ছে! কিন্তু কোনো সংবাদপত্র এগুলো প্রকাশ করে নাহ । ঐ শুধু ফেইসবুক ও টুইটারে খবর পাই আমরা!


ঢাকা শহরে দেবোত্তর সম্পত্তির করুণ দশা

ঢাকা শহরের হিন্দু সম্প্রদায় দেশের অন্যান্য এলাকার হিন্দুদের তুলনায় কিছুটা নিরাপদ মনে করেন- এরকম কথাই প্রচলিত রয়েছে । এই নিরাপদ ঢাকা শহরের দেবোত্তর সম্পত্তির কী অবস্থা তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা এখানে দেওয়া হলো । সমগ্র দেশের তালিকা দিতে গেলে আলাদা একটি বই অনায়াসে লেখা যাবে ।


১. ঢাকেশ্বরী মন্দির: হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান মিলনকেন্দ্রও নিরাপদ নয়

ঢাকা শহরের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান মিলনকেন্দ্র ঢাকেশ্বরী মন্দির । এই মন্দিরটির ওপর বিভিন্ন সময়ে এসেছে হামলা, ধ্বংস করা হয়েছে প্রতিমা, লুট করা হয়েছে মন্দিরের মূল্যবান সামগ্রী । বি.এন.পি ঢাকেশ্বরী মন্দিরের নিজস্ব জায়গায়, মন্দিরের গা ঘেঁষে তাদের লালবাগ অঞ্চলের একটি অফিস করেছে । মন্দিরের অন্যান্য অনেক জায়গাও দখল করার চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে ।

২. রায়ের বাজারের দেবোত্তর সম্পত্তি দখল: ‘বৈশাখী যুব সংগঠন’ ও জালিয়াত চক্রের আগ্রাসন

ঢাকা শহরের রায়ের বাজার এক সময়ের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা । এখনো এই রাজধানী শহরের যে সব এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগরিক বসবাস করেন তার মধ্যে রায়ের বাজার এলাকা অন্যতম । রায়ের বাজারের পালদের গদি ঘরের মন্দিরের সম্পূর্ণ জায়গা 'বৈশাখী যুব সংগঠন' নামে একটি সংগঠনের দখলে । এই সংগঠনটির মূল নেতা জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) জনৈক আনোয়ার হোসেন । গদি ঘর মন্দির কম্পাউন্ডে তিনটি মন্দির ছিল কালী মন্দির, দুর্গা মন্দির ও লক্ষ্মী মন্দির। বি এন পির এই নেতা বৈশাখী যুব সংগঠনের নামে এই তিনটি মন্দিরের ইমারত ও খালি জায়গা দখল করে নিয়েছে। পালদের গদি ঘরের মন্দিরের শুধু জায়গার মূল্য প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা । আনোয়ার হোসেন তার দল নিয়ে মন্দির দখল করার পর প্রথম যে কাজটি করেছে তা হচ্ছে মন্দিরের প্রতিমাগুলো মন্দির এলাকার বাইরে ছুঁড়ে ফেলা ।


৩. জাল দলিলের ফাঁদ: কালীমন্দির ও অন্যান্য দখল

খতিয়ান ৫ দাগ ২২১ মৌজা সরাই জাফরাবাদ হোল্ডিং ৩২১- এই সম্পত্তির মালিক শ্রীশ্রী কালীমন্দির । এই মন্দিরটি পুলপাড়ের মন্দির নামে সমধিক পরিচিত । উক্ত দাগ নম্বরে মন্দিরের জায়গার পরিমান তিন কাঠা । কিন্তু ৩২২/২ জাফরাবাদের রওশন আরা বেগম এই কালী মন্দিরের এক কাঠার উপরে জায়গা দখল করে নিজের বাড়ির সঙ্গে এক করে দেয়াল তুলেছে । রওশন আরা বেগমের দখলীকৃত এই এক কাঠা জায়গার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় দশ লক্ষ টাকা । ১২৯৮ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠিত এই কালী মন্দিরটির বাকি জায়গাও দখল করার চক্রান্ত করা হচ্ছে, জানিয়েছেন উক্ত মন্দির কমিটির সহসভাপতি সমরেশচন্দ্র পাল ।

৪. শ্মশান দখলের ষড়যন্ত্র: এডভোকেট মোহাম্মদ আলী খানের অপতৎপরতা

বারো বছর পূর্ণ হবার আগে কোনো হিন্দু শিশু মারা গেলে তাকে মাটি গর্ত করে সমাহিত করার নিয়ম রয়েছে । কিন্তু রায়ের বাজার জাফরাবাদ শ্মশানে কোনো শিশুকে কবর দিতে দিচ্ছে না ২৮ নং জাফরাবাদের অধিবাসী এডভোকেট মোহাম্মদ আলী খান পিতা ইসমাইল খাঁ ওরফে টোকানী । উক্ত মোহাম্মদ আলী খান শ্মশানঘাটটি দখল করার উদ্দেশ্যে শ্মশানের যাতায়াতের রাস্তাটিও দখল করে নিয়েছে ।


৫. রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের দখল: টিপু সুলতান রোড ও লালবাগের ঘটনা

পুরান ঢাকার টিপু সুলতান রোডের রাধাবিনোদ জিউর মন্দিরের সম্পূর্ণ জায়গা দখল করে নিয়েছে মানিকগঞ্জ জেলার বি এন পির সভাপতি মোঃ আবদুর রাজ্জাক ।

লালবাগের সারঙ্গধর রঘুনাথজী মন্দিরটি দখল করার উদ্দেশ্যে কিছুদিন আগে হামলা করেছে স্থানীয় বি এন পি নেতা হাজী মোঃ সেলিম (বর্তমানে আওয়ামী দলীয় সাংসদ) । হামলা করার সময় সে মন্দিরের সম্পূর্ণ জায়গা ক্রয় করেছে বলে দাবী করে । অথচ সামান্য লেখাপড়া জানা লোকও জানেন, মন্দিরের জায়গা দেবোত্তর সম্পত্তি যা কেনাবেচার অধিকার কারো নেই ।


স্বামীবাগ আশ্রম: জাল দলিলের ভয়ংকর দৃষ্টান্ত

শ্রীরুদ্র ত্রিদণ্ডী ত্রিপুরলিঙ্গ স্বামী ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দে ৭৯, স্বামীবাগ রোডে 'স্বামীবাগ আশ্রম' প্রতিষ্ঠা করেন । এই আশ্রমের জমির পরিমাণ প্রায় চার বিঘা । পুরো জায়গাটি দেয়াল দিয়ে ঘেরা । আশ্রমে রয়েছে শিব মন্দির, কালী মন্দির, হরগৌরী মন্দির এবং শ্মশান ও মঠ । ১৯৭১-এ এই আশ্রমে হামলা করেছে, আগুন দিয়েছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী । ১৯৯২ তে লুট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে এদেশের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ।' স্বামীবাগ আশ্রমের পুরো সম্পত্তি দেবোত্তর সম্পত্তি। এই চার বিঘা জমির বর্তমান বাজার মূল্যে প্রায় চার কোটি টাকা । স্বামীবাগ আশ্রমের এই জমি দখল করার উদ্দেশ্যে খলিলুর রহমান বিশ্বাস, পিতা মিলাপ বক্স বিশ্বাস সাং সুমিরদিয়া, থানা ও জেলা চুয়াডাঙ্গা- একটি দলিল প্রদর্শন করেছে । দলিলের ভাষ্যানুযায়ী উক্ত খলিলুর রহমানের পিতা ২৮ ডিসেম্বর ১৯২১ খ্রঃ ত্রিপুরলিঙ্গ স্বামীর নিকট থেকে এই চার বিঘা জমি কিনেছিলো । নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে এই জমি রেজিষ্ট্রি হয়েছিল উল্লেখিত তারিখে । দলিল নম্বর ৫৮৪১ । কিন্তু স্বামীবাগ আশ্রমের সেবায়েত শ্রী যশোদানন্দন আচার্য কৃষ্ণনগর রেজিস্ট্রি অফিসে নিয়ম মাফিক খোঁজ খবর নিয়ে দেখেছেন উক্ত নম্বরের দলিলটি মিলাপ বক্স বিশ্বাসের নামে করা হয়নি ।

ত্রিপুরলিঙ্গ স্বামী ১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রায় ১৫০ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেছেন । মৃত্যুর অনেক আগেই তিনি স্বামীবাগ আশ্রমের বরাবর এই চার বিঘা জমি দান করেছিলেন । সে দানপত্রের মূল কপি আশ্রমের সেবায়েতের নিকট রক্ষিত রয়েছে ।

স্বামীবাগ আশ্রমের এই চার বিঘা জমি দখল করার উদ্দেশ্যে আরো একটি নকল দলিল প্রদর্শন করা হয়েছে । এই দলিলটি ১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দের । কিন্তু আগেই উল্লেখ করেছি স্বামী ত্রিপুরলিঙ্গ ১৯২৩-এ পরলোকগমন করেছেন । ১৯২৭ এর যে নকল দলিলটি প্রদর্শন করা হয়েছে সে দলিলে-বিক্রেতা হিসাবে স্বামী ত্রিপুরলিঙ্গের স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে ।

অবৈধ দখলের মূল কারণ ও সমাধান

এভাবে মৃতব্যক্তির স্বাক্ষর জাল করে অথবা বিভিন্ন রকম ধোঁকাবাজির আশ্রয় নিয়ে জাল দলিল বানিয়ে এদেশের এক শ্রেণীর অসৎ লোক দেবোত্তর সম্পত্তি দখল করে নিচ্ছে । দখল নেওয়ার আগে তারা দেবোত্তর সম্পত্তির সেবায়েত বা রক্ষকদের নানা রকম ভয়ভীতি, জীবননাশের হুমকি দিয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছে ।

দেবোত্তর সম্পত্তির কাস্টডিয়ান জেলা জজ । উক্ত সম্পত্তির ভিতরে যে সব মন্দির উপাসনাগার অথবা অন্য কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নকল্পে জেলা জজের অনুমতি সাপেক্ষে প্রকৃত সেবায়েত আংশিক জমি বিক্রি করতে পারেন এরকম বিধান রয়েছে। কিন্তু মন্দির বা ধর্মীয় স্থানের উন্নয়নকল্পে এদেশে কোনো দেবোত্তর সম্পত্তি বিক্রি করা হয়নি । তবুও সারা দেশের অধিকাংশ দেবোত্তর সম্পত্তি অবৈধ দখলদারদের দখলে চলে গেছে ।

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্যে দেবোত্তর সম্পত্তির অংশ বিশেষ বিক্রি করার প্রয়োজন পড়ে না এজন্যে যে, এদেশের কোনো মন্দির বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নতুন করে উন্নয়ন হয়েছে এরকম উদাহরণ নেই বললেই চলে । যা হয়েছে সেখানে ব্যক্তিগত দান, প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তহবিল ব্যয় করা হয়েছে । কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারি অনুদান পাওয়ারও উদাহরণ রয়েছে। যেমন- হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্টের নামে আড়াই কোটি টাকার হিন্দু কল্যাণ তহবিল রয়েছে । যদিও ধর্মীয় খাতে সরকারি অনুদানের ক্ষেত্রে এই পরিমান অর্থ খুবই অপ্রতুল ।

দেবোত্তর সম্পত্তি দখল করার আরো অসংখ্যা অবৈধ পন্থার নজীর রয়েছে । সে সব নজীর এখানে তুলে না ধরে শুধু একটি প্রস্তাব রাখবো দেবোত্তর সম্পত্তি দখল এবং দখল করার যেসব অবৈধ পন্থা অবলম্বন করা হয় এবং যারা তা করে তাদের জন্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হলেই এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষে নির্বিঘ্নে উপাসনা করা সম্ভব ।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
Post a Comment (0)
To Top