মহাত্মা গান্ধীর শেষ পরীক্ষা: নোয়াখালিতে পদযাত্রা
চাঁদপুর ।
বাংলার অখ্যাত একটি গ্রাম ।
নারকেল গাছের ছায়ায়, যে গ্রামের মেটে পথ দিয়ে হাঁটছিলেন সে মানুষটি বৃদ্ধ । বয়সের ভারে বেশ কিছুটা নুয়ে পড়েছেন । কিন্তু পথ চলার বিরাম নেই । অনেক দূর যেতে হবে তাঁকে । গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে যাবেন । সকলের অভিযোগ শুনবেন । প্রয়োজনে উপদেশ দেবেন । মাত্র গত মাসে আটাত্তর বছরে পা দিলেন । তবু রেহাই নেই । 'কর্তব্য' তাঁকেসুদূর দিল্লী থেকে বাংলায় টেনে এনেছে । অনেকদিন ধরেই বাংলায় আসবেন মনস্থির করেছিলেন । 'কলকাতা দাঙ্গা' তাঁর সমস্ত বিশ্বাসকে আঘাত করেছিল । কিন্তু আবার দাঙ্গা! মাত্র দু'মাসের মধ্যে । এবং এই বাংলায় । কিন্তু তখন তিনি আসতে পারেননি । কারণ নিজের 'কর্তব্য' তিনি তখন বুঝে উঠতে সমর্থ হননি । তাঁর 'অন্তর আত্মা (Inner Voice)তাঁকে কোন নির্দেশ দেয়নি । বাংলা তাঁর কাছে যেন এক ভিন্ন গ্রহ। বাংলা তাঁকে অস্বীকার করেনি। কিন্তু তাঁকে মেনেও নেয়নি । তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্বের কাছে সমস্ত ভারত যখন আত্মসমর্পন করেছে, এই বাংলাই তখন এক বেয়াদপ ঘোড়ার মতো ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থেকেছে । কোন চাবুকেই পোষ মানানো যায়নি সে ঘোড়াকে। বরং, তাঁর দুর্দমনীয় অমোঘ ব্যক্তিত্বের সাথে বাংলা সংঘাতে গেছে।তাঁর নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। তাঁর ব্যক্তিত্বের ছটায় নিজের বিদ্রোহী আত্মাকে ভুলে যায়নি । বাইরে থেকেমানুষটির এই বিশাল ব্যক্তিত্বের স্বরূপ অনুধাবন করা যায় না । বাস্তবিকই অতি সাধারণ চেহারা । কৃশ শরীর, বেঁটে গড়ন, সামঞ্জস্যহীন হাত পা । প্রকৃতি মানুষটার প্রতি সামান্য বদান্যতাও দেখায়নি । লম্বা কুলোর মতো কান, মোটা নাক, ঝুলানো ঠোঁট আর দাঁতবিহীন ভাঙাচোরামুখ । কিন্তু মানুষটি ভারতবর্ষের মুকুটহীন সম্রাট । মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী । মহাত্মা । জাতির পিতা । সাধারণ মানুষের অনুভূতি আর আবেগ বুঝবার এক অসাধারণ দৈব ক্ষমতার অধিকারী । তাঁর অনুগামীদের কাছে, তিনি একাধারে যোদ্ধা সন্ন্যাসী ও মানবপ্রেমী। ইংরেজ আমলাদের কাছে গান্ধী একজন 'bogus messiah' ।
ইংরেজ বুদ্ধিজীবীদের কাছে, 'He was a strange blend of great moral principles and quirky obsessions' আপামর ভারতবাসীর কাছে, গান্ধীজী মহাত্মা, বড় আপনার মানুষ। গান্ধীজী নোয়াখালি জেলা সফর করেছিলেন । দাঙ্গায় সর্বস্বান্ত হয়েযাওয়া প্রিয়জন হারানো পরিবারগুলির পাশে এসেছেন তিনি। সঙ্গীসাথী পরিবৃত হয়ে নয় । মাত্র চারজন সঙ্গী নিয়ে গান্ধীজী নোয়াখালি সফরে এসেছেন । আর তাঁর সাথে আছে তিনটি বাঁদরের সেই বিখ্যাত মূর্তি । যারা কারোর দোষ দেখে না, কারোর নিন্দা শোনে না,কারোর নিন্দা করে না । দিল্লীতেই গান্ধীজী জানিয়েছিলেন, দাঙ্গা কবলিত নোয়াখালি সফরে তিনি একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া আর কাউকে সঙ্গে চান না । কারণ হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে এটাই তাঁর শেষ এবং চরম পরীক্ষা (last and greatest experiment) । গান্ধীজীর জীবনের সমস্ত উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে চলেছে । সেই দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে শুরু । তারপর তাঁর হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের পরীক্ষা পূর্ণতা পেয়েছিল খিলাফত্ আন্দোলনে । অনেকেই সেদিন গান্ধীকে বারণ করেছিলেন । বার বার গান্ধীজীকে সতর্ক করা হয়েছিল এভাবে বিজাতীয় সাম্প্রদায়িক তাস খেলার বিপদ সম্পর্কে । কিন্তু গান্ধী শোনেননি । এটাই তাঁর বিশেষত্ব। তিনি সবসময় বিপরীতমুখী । সকলের থেকে আলাদা, স্বতন্ত্র । তিনি সকলের সাথে চলেন না,সকলকে তাঁর সাথে চলতে হয় । তাই যখন আপামর ভারতবাসী আন্দোলন চেয়েছে, তিনি তখন মৌনী। বার বার তিনি তাঁর সত্যাগ্রহ আর অহিংস আন্দোলনের রাশ টেনে ধরেছেন মাঝপথে । 'ভারত ছাড় আন্দোলন' শুরু করেছেন শেষ অধ্যায়ে। একলা চলাতেই তাঁর বেশী আনন্দ । রবীন্দ্রনাথের ঐ গান তাঁর সবচাইতে প্রিয়, 'একলা চলো রে' । নোয়াখালি তাঁর হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক পরীক্ষার শেষ অধ্যায় । এই শেষ পরীক্ষার সাফল্যের উপর নির্ভর করবে তাঁর আগামী দর্শনের ভিত্তি । এখানে তিনি এসেছেন তাঁর নিজের ভাষায়, 'to rekindle the lamp of neighbourliness' এই পরীক্ষাকে সার্থক রূপ দেবার জন্য তিনি মুসলমানদের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন হিন্দু ভাইদের রক্ষা করে । কিন্তু হিন্দুদের রক্ষার দায়িত্ব হিন্দুদেরহাতে তুলে দিতে তাঁর আপত্তি আছে । তাই হিন্দুদের পরামর্শ দিয়েছেন, তারা যেন বীরের মতো, পবিত্র মনে মুসলমানদের তরবারির কাছে নিজেদের সমর্পণ করে ।
গান্ধীজীর নিজের কথায়,
"It is the duty of every Hindu not to harbour any thought of revenge". "Hindus should not die helplessly, but face death bravely and without a murmur"
নোয়াখালিতে তাঁর এই শেষ পরীক্ষা 'last and greatest experiment' ব্যর্থ হয়েছিল । মুসলমানরা সেখানে হিন্দুদের রক্ষা করেনি । হিন্দুরাও নীরবে নিজেদের মুসলমানদের তরবারির কাছে আত্মসমর্পণ করেনি । তারা পালিয়ে এসেছিল । ধর্ম বাঁচাতে, মেয়েদের সম্মান বাঁচাতে এবং প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে । যারা পালাতে পারেনি, 'হয় কোরাণ নয় মৃত্যু' একটা তাদের বেছে নিতে হয়েছে । কিন্তু গান্ধীজীর 'শেষ এবং মহত্তম পরীক্ষা' এখানেই শেষ হয়নি । বরং আরো মহৎ পরীক্ষার সোপান তৈরী করেছে । তাই পাঞ্জাবের ধর্ষিতা মহিলাদের তিনি উপদেশে দিয়েছেন, তারা যেন জিহ্বায় কামড় দিয়ে ধর্ষণের জ্বালা আর অপমান সহ্য করে নেয় । (His advice to girls menaced with rape in Punjab had been to bite their tongue and hold their breath until they died) । বাধা দেওয়া চলবে না । কোন কারণেই 'অহিংসার' বিচ্যুতি ঘটানোর পরামর্শ তিনি দিতে পারেন না । দাতা হিসাবেও গান্ধীজী মহৎ । শুধু 'পাকিস্তান' দাবী মেনে নিয়ে তিনি তৃপ্ত নন । তাই জিন্না যখন দাবী করেছেন পাকিস্তানকে তার প্রাপ্য ৫০০ মিলিয়ন টাকা দিয়ে দিতে হবে, গান্ধীজী হুমকি দিয়েছেন, ভারত সরকার ঐ টাকা পাকিস্তানকে না দিলে তিনি আমৃত্যু অনশন শুরু করবেন । 'Gandhi's demand for the payment of Pakistan's 500 million rupees', 'হিন্দুরাষ্ট্র' পত্রিকা অফিসের টেলিপ্রিন্টারে বুলেটিনটা দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন এক মারাঠি যুবক । 'আর নয়' । অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল কথাগুলি । 'Let Gandhi die', গান্ধীকে মরতে হবে,নাথুরাম গডসে দৃপ্ত স্বরে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আপ্তেকে জানিয়েছিলেন তাঁর আগামী কর্মসূচী । গডসে কি গান্ধীকে হত্যা করেছিলেন? না ।
![]() |
নোয়াখালীতে করমচোঁদ গান্ধী |
অনেক আগেই গান্ধীর মৃত্যু পরোয়ানা লটকে দেওয়া হয়েছিল । গান্ধীজী তো শুধু রক্ত মাংসের মানুষ নন । একজন যোদ্ধা, একজন সন্ন্যাসী । গান্ধীজী একটি মানুষের নাম নয় । গান্ধীজী একটি প্রেরণা, একটি আদর্শ । অন্ততঃ তাঁর অনুগামীদের কাছে। গান্ধীজী নিজেও দাবী করেছেন "আমার জীবনই আমার বাণী । কিন্তু গান্ধীজী তাঁর আদর্শেঅনুপ্রাণিত শিষ্য তৈরী করতে পারেননি । যাঁরা গান্ধীবাদের নামাবলী গায়ে চাপিয়েছিলেন, তাঁরা কেউ প্রকৃত গান্ধীবাদী ছিলেন না । নেহরু, আজাদ, রাজা গোপালাচারী, প্রত্যেকেই গান্ধীজীর উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের সূর্য ছটায় নিজেদের আলোকিত করতে চেয়েছিলেন মাত্র! এটাই গান্ধীজীর জীবনের সর্বচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি । তিনি যাঁদের বিশ্বাস করেছেন, ভালোবেসেছেন, তাঁরা কেউই তাঁর সাথে ছিলেন না । গান্ধীজীর সরল জীবনযাপন পাশ্চাত্য কেতায় মানুষ হওয়া নেহরু কোনদিন শ্রদ্ধার চোখে দেখেননি । মাংস ও মদের প্রতি নেহরুর ভালোবাসা ছিল প্রশ্নাতীত । গান্ধীজী নিজেও নেহরু সম্পর্কে আক্ষেপ করেছেন,
'He is more English than Indian.
গান্ধীজীর 'সত্য প্রিয়তা' আজাদের জীবনে কোন প্রভাব বিস্তার করেনি । জীবনের শেষ প্রান্তে এসে গান্ধীজী তাঁর শিষ্যদের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন । শিষ্যদের ক্ষমতার কোন্দল ও স্বার্থদুষ্ট রাজনীতি থেকে দেশকেবাঁচাবার জন্য তাই তিনি কংগ্রেস দলকে ভেঙ্গে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন ।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও দ্বিজাতি তত্ত্ব
হিন্দু সমাজ থেকে একজন চলে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে শুধু একটি সংখ্যা কমে গেল । বরং একজন নতুন শত্রু সৃষ্টি হল । গুজরাটের সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারটি মাত্র দু'পুরুষ আগে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিল । পিতামহ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ধর্মীয় গোঁড়ামি বলতে যা বোঝায়, বাড়িতে সেরকম আবহাওয়া কোনদিন ছিল না । তাই নাতির মানসিক বিকাশ হয়েছিল সম্পূর্ণ খোলা পরিবেশেই । ঐ নাতিটিই তৎকালীন ভারতীয় রাজনীতিতে সবচেয়ে বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব বিজাতীয় ভাবাবেগ উস্কে দিয়ে রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণ করবার নীতি এই মানুষটি সমর্থন করতেন না । তাই তুরস্কের খলিফার সমর্থনে গান্ধীজীর ডাকা খিলাফত আন্দোলন সমর্থন তিনি করেননি । বরং আইনসভায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি 'a nationalist first, nationalist second and nationalist third' ।
দেশের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা তাঁকে লোকমান্য তিলকের কাছে নিয়ে এসেছিল । তিলকের হয়ে বোম্বে হাইকোর্টে তিনি যে ঐতিহাসিক মামলা লড়েছিলেন, স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে তা চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে । সমস্ত ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামি মুক্ত এবং 'আসুরিক' ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন এই মানুষটির মধ্যে অনেকেই আশার আলো দেখেছিলেন । মহামতি গোখলে মানুষটির উপর তাঁর গভীর বিশ্বাস এবং উচ্চাশা স্থাপন করে লিখেছিলেন,
'he has true stuff in him, and that freedom from all sectarian prejudice which will make him the best ambassador of Hindu-Muslim unity"
এমনকি মুসলীম লীগে যোগ দেওয়ার পরও তাঁর দেশপ্রেমের বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি বা বিকৃতি ঘটেনি। সরোজিনী নাইডু এই ভারতীয় সাহেবটির মুসলীম লীগে যোগদান সম্পর্কে লিখেছেন,
"His two sponsors were required to make a solemn preliminary covenant that loyality to the Muslim League and the muslim interest would in no way and at no time imply even the shadow of disloyalty to the larger national cause, to which his life was dedicated."
পারিবারিক জীবনে একা,সামাজিক জীবনে বন্ধুহীন, চরম 'নিয়মতান্ত্রিক' (constitutionalist) মহম্মদ আলি জিন্না ইসলাম সম্পর্কে কোনদিনই উৎসাহী ছিলেন না । কোরাণ তিনি কখনও পড়ে দেখেননি । এম. এল. এ. হিসাবে শপথ নেওয়ার সময় কোরাণ ছুঁতে হয়েছে বটে, কিন্তু কোরাণের ভেতর কী আছে তা জানবার ইচ্ছা জিন্নার কোনদিন হয়নি । বরং ইসলাম তাঁর কাছে ছিল 'nonsense' । মসজিদে গিয়ে জিন্না নামাজ পড়েছেন বলে জানা যায় না । বরং সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে নিজেকে দেখতে ঘৃণা বোধ করতেন এই কেতাদুরস্ত ব্যারিস্টার।ডঃ আম্বেদকর জানিয়েছেন,
"he (Jinnah) was never known to be a very devout, pious or a professing Muslim. Besides kissing the Holy Quran as and when he was sworn in as an M. L. A., he does not appear to have bothered much about its contents or its special tenets. It is doubtful if he frequented any mosque either out of curiosity or religious fervour. Mr. Jinnah was never found in the midst of Muslim mass congregations, religious, or political."
মদ্যপান ছিল জিন্নার অবসর কাটানোর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিনোদন । ইসলামে নিষিদ্ধ সূরার মধ্যে তিনি 'বেহেস্তে'র সুখ উপভোগ করতেন । মুসলমানদের কাছে সবচেয়ে অপবিত্র শুয়োরের মাংস ছিল তাঁর প্রিয় খাদ্যগুলির অন্যতম । মদ এবং শুয়োরের মাংস রোজই শোভা পেত জিন্নার খাবার টেবিলে । জিন্না উর্দু ফারসী ভাষা জানতেন না । ভারতীয় মুসলমানদের নিজের বন্ধু ভাবতে তিনি শিউরে উঠতেন ।কিন্তু তবু মহম্মদ আলি জিন্না হয়ে উঠলেন দেশের আট কোটি মুসলমানের সর্বসম্মত নেতা । ১৯৩৭ সালের রাজ্য আইনসভা (বিধানসভা) নির্বাচন ছিল মহম্মদ আলি জিন্নার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঁক নেওয়ার মুহূর্ত । জিন্না মুসলীম লীগে যোগ দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু জাতীয়তাবাদী ধ্যান ধারণায় তাঁর তখনও অবিচল বিশ্বাস ছিল । এমনকি, ১৯৩৩ সালে জিন্না ইংল্যান্ড সফরে গেলে, সেখানে পাকিস্তান পরিকল্পনার জনক রহমত আলি তাঁকে 'পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনে'র আন্দোলন করবার পরামর্শ দিলে জিন্না সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন । পাকিস্তান তাঁর কাছেছিল, "an impossible dream".
এই নির্বাচনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল । তা হল, জিন্নার জননেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবার প্রথম পরীক্ষা । কারণ,জিন্না লীগের নেতৃত্বে আসবার পর সেটা ছিল প্রথম নির্বাচন । কিন্তু নির্বাচনে মুসলীম লীগ ব্যর্থ হল । বাংলা, পাঞ্জাব, সিন্ধুর মতো মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যগুলিতেও মুসলীম লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটল । বাংলায় ক্ষমতা দখল করল ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি । পাঞ্জাবে ক্ষমতায় এল পাকিস্তান আন্দোলনের চরম বিরোধী স্যার খিজির হায়াৎ খানের নেতৃত্বাধীন ইউনিয়নিস্ট পার্টি । সিন্ধু প্রদেশে রাজ্য আইনসভার তিরিশটি আসনের মধ্যে লীগের ভাগ্যে জুটল মাত্র তিনটি আসন ।
লীগের এই পরাজয় জিন্না রাজনৈতিকভাবে গ্রহণ করলেন না । বরং ব্যক্তিগত অপমানের পর্যায়ে নিয়ে গেলেন । এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এবার শুরু হল তীব্র হিন্দু বিরোধী প্রচার । মাত্র কয়েকদিন আগেও যে জিন্না নিজের পরিচয় দিতেন 'a nationalist first' বলে, এখন তিনিই দাবী করলেন, "কয়েক শতক আগে যেদিন প্রথম হিন্দুটি ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিল সেইদিনই পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে ।” (Pakistan was born the day when the first Hindu was converted to Islam centuries ago)
২৩শে মার্চ, ১৯৪০, মুসলীম লীগের লাহোর সম্মেলনে 'পাকিস্তান প্রস্তাব' গৃহীত হল । মহম্মদ আলি জিন্না ব্যাখ্যা করলেন, "ভারতবর্ষের সমস্যা সম্প্রদায়গত নয়, বরং জাতিগত! এটা খুবই দুঃখের যে হিন্দু বন্ধুরা ইসলাম এবং হিন্দুত্বের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পারছেন না! ইসলাম এবং হিন্দুত্ব শুধুমাত্র আলাদা ধর্ম নয়, সম্পূর্ণ বিপরীত দুই জাতি সত্ত্বা । এই ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে হিন্দু ও মুসলমানরা দুটি পৃথক ইতিহাস থেকে প্রেরণা পায়। এদের একজনের মহাপুরুষ অন্যজনের শত্রু । মুসলমানরা সংখ্যালঘু নয় । মুসলমান একটা জাতি । জাতি গঠনের সমস্ত প্রয়োজনীয় উপাদান তাদের আছে । তাই তাদের অবশ্যই নিজের বাসভূমির অধিকার আছে ("Mussalmans are not a minority...Mussalmans are a nation according to any definition of a nation, and they must have their own homeland, their territory and their state").
কিন্তু জিন্না ভালোভাবেই জানতেন, যতই হৈচৈ করা হোক না কেন, মুসলীম লীগের একার পক্ষে কখনোই পাকিস্তান আদায় করা সম্ভব নয় । তাই 'হাসতে হাসতে' পাকিস্তান পেয়ে অবাক জিন্না তাঁর A.D.C.-র কাছে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন, "আমি কখনোই আমার জীবনে পাকিস্তান দেখে যেতে পারব ভাবিনি ।" (I never thought it would happen, I never expected to see Pakistan in my lifetime)
প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেসের বে-হিসাবী নেতারাই জিন্নাকে পাকিস্তানের ব্যাপারে উৎসাহিত করে তুলেছিলেন । ১৯৪৪ সালে গান্ধীজী জিন্নার সাথে বেশ কয়েকবার মিলিত হয়েছিলেন । তিনি সেখানে জিন্নাকে 'কায়েদ-ই-আজম' বলে সম্বোধন করলেন । কিন্তু গুজরাটি রীতি অনুযায়ী তাঁকে 'জিন্নাভাই' বলে সম্বোধিত করবার কথা। জিন্না কিন্তু গান্ধীজীকে 'মিঃ গান্ধী' বলেই সম্বোধন করেছিলেন । ঐ সময় গান্ধীজী মহম্মদ আলি জিন্নার কাছে করুণা ভিক্ষা করেন, "আমি আপনার বা ইসলামের শত্রু নই। আমি আপনাদের দীন সেবক (Servant) মাত্র । আমাকে দয়া করে ফিরিয়ে দেবেন না ।
গান্ধীজীর এই অপমানকর আত্মসমর্পণে উৎফুল্ল জিন্না লীগ কার্যনির্বাহী কমিটিকে জানিয়েছিলেন,
"At last-and is good and conducive to further progress... Mr. Gandhi has, at any rate in his personal capacity; accepted the principles of partition or division of India."
১৯৪৫-৪৬ সালে কেন্দ্রীয় আইনসভার (পার্লামেন্ট) নির্বাচন হল । মুসলীম লীগ তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে 'পাকিস্তান' রাষ্ট্রের সমর্থনে 'মুসলমান জাতি'কে ভোট দিতে আহ্বান জানাল (Muslim League fought on the single issue of Pakistan) । কংগ্রেস নির্বাচনে নেমেছিল 'স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ ভারত'কে ইস্যু করে । কিন্তু হিন্দু মহাসভার প্রধান বীর সাভারকর জাতিকে এই বলে সতর্ক করলেন যে, কংগ্রেসের দুর্বল নেতৃত্বর পক্ষে মুসলীম লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতিকে প্রতিহত করা সম্ভব নয় । তাই কংগ্রেসকে একটি ভোট মানেই পাকিস্তানের সপক্ষে একটি ভোট । কিন্তু সাভারকরের এই 'সঠিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণ' সাধারণ মানুষের মনে দাগ কাটতে ব্যর্থহল । হিন্দুদের ভোট পেল কংগ্রেস । কিন্তু মুসলীম সংরক্ষিত আসনে কংগ্রেসের মুসলমান প্রার্থীদের শোচনীয় পরাজয় ঘটল । লীগ ৮৬.৬% মুসলমান ভোট পেয়ে সংরক্ষিত ৭৯টি আসনের মধ্যে ৭৬টি আসনে জয়লাভ করল, কংগ্রেসের ভাগ্যে জুটল মাত্র ৩টি মুসলিম আসন । ১৮ মুসলীম আসনগুলিতে কংগ্রেসের এই শোচনীয় পরাজয় সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জিন্না দাবী করলেন, "মুসলমানরা কংগ্রেসের সাথে আছেবলে যে দাবী করা হচ্ছে তা সর্বৈব মিথ্যা । আইন পরিষদে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ৭৯টি আসনের মধ্যে কংগ্রেসের মুসলমান প্রার্থীরা মাত্র ৩টি আসনে জয়লাভ করতে পেরেছে, এবং ঐ কুলাঙ্গাররা (যে মুসলমানরা কংগ্রেসের টিকিটে জিতেছেন) সর্বত্রই পদাঘাত পাচ্ছেন (kicked out anywhere)"
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস
১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ইংল্যান্ডের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলিক্যাবিনেট মিশনের কথা ঘোষণা করলেন । ভারতে ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার জন্য মুসলীম লীগ ও কংগ্রেস, উভয় পক্ষকেই আমন্ত্রণ জানালেন । মৌলানা আবুল কালাম আজাদ তখন কংগ্রেস সভাপতি। মহম্মদ আলি জিন্না 'হিন্দু কংগ্রেসে'র 'মুসলমান' প্রতিনিধির সাথে আলোচনায় বসতে রাজী হলেন না । কারণ, 'Hindus were "enemies", he (Jinnah) said, but non-League Muslims were "taritors". He could not deal with "traitors". (জিন্না বললেন, হিন্দুরা হচ্ছে "শত্রু”, কিন্তু অ-লীগপন্থী মুসলমানরা হচ্ছে বিশ্বাসঘাতক এবং তিনি বিশ্বাসঘাতকদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালাবেন না ।
![]() |
প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিন | কলকাতা |
দুঃখজনক সন্দেহ নেই, কংগ্রেস জিন্নার এই দাবীর কাছে মাথা নিচু করে, 'হিন্দু' নেহরুকে সভাপতির প্রতিনিধি নিয়োগ করল । জিন্না আরো দাবী করলেন, কেন্দ্রের আসন্ন অস্থায়ী মন্ত্রীসভার 'হিন্দু কংগ্রেসে'র কোন মুসলমান প্রতিনিধি থাকা চলবে না । মৌলানা আজাদ পার্টির ওয়ার্কিং কমিটির অজ্ঞাতসারে জিন্নার এই দাবী স্বীকার করে নিয়ে ভাইসরয়কে চিঠি দিলেন । পরে স্ট্যাফোর্ড ক্রীপস্গান্ধীজীকে ঐ চিঠিটি দেখালে আজাদ তাঁর 'হাতের লেখা' চিঠির কথা বেমালুম অস্বীকার করেন ।
গান্ধীজীর সর্বসময়ের সঙ্গী সুধীর ঘোষ তাঁর "Gandhiji's Emissary" গ্রন্থে লিখেছেন:
Gandhiji asked Maulana Saheb a straight question whether he had written any letter to the Viceroy about the negotiations that were going on. The Maulana flatly denied having written any letter at all. He did this while the letter in original was lying in front of Gandhiji on his little desk at a distance of two or three yards from the spot where Maulana Saheb was sitting...what deeply upset Gandhiji was that a life long colleague to whom he had such unflinching loyalty could be so untruthful...."
এদিকে ৬ই জুলাই বোম্বেতে এক প্রেস কনফারেন্সে নেহরু ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব অস্বীকার করলেন । জিন্নার পক্ষে কংগ্রেসের এই পদক্ষেপ মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না । ক্ষিপ্ত জিন্নাতাঁর 'নিয়মতান্ত্রিক' (constitutionalist) ইমেজ ছেড়ে রাস্তায় নেমে এলেন । শুরু হল প্রত্যক্ষ সংগ্রামের (Direct Action) প্রস্তুতি । রহমান আলী আগের দিন রাতেই তার লোকজন নিয়ে কলকাতায় চলে এসেছিল । খিদিরপুর, কলুটোলা, রাজাবাজার, ধর্মতলা, পার্কসার্কাস, তালতলা; রহমানের লোকজন কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল । আগেই রহমান আলী সমস্ত 'হিসাব-নিকাশ' পরিষ্কার করে নিয়েছিল । লুটের মালের কোনো বখরা কাউকে দিতে হবে না । খুন, ধর্ষণ, অপহরণ-না, পুলিশ এ সমস্ত ছোটখাট ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। বলা হল, ১৬ই আগস্ট, 'প্রত্যক্ষ সংগ্রামে'র দিন মুসলীম লীগের কর্মীরা জায়গায় জায়গায় মিটিং করে পাকিস্তানের পক্ষে জনমত সংগঠিত করবে ।
বাংলায় অবশ্য ১৬ তারিখ লীগের তরফ থেকে বনধূডাকা হল। সুরাবর্দী তখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী (Premier) । তাঁর নেতৃত্বাধীন মুসলীম লীগ সরকার ঐ দিন বাংলায় 'ছুটির দিন' ঘোষণা করল। 'প্রত্যক্ষ সংগ্রামে'র প্রতি 'প্রত্যক্ষ' সমর্থন আর কি! রাজ্যের কংগ্রেস নেতারা সরকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হৈচৈ করলেন বটে, কিন্তু রাজ্য আইনসভার চার দেওয়ালের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ রাখা হল । 'প্রত্যক্ষ সংগ্রাম' বা বাংলা বন্ধর বিরুদ্ধে বাংলার জনচেতনা সংগঠিত করবার কোন প্রয়াস তাঁরা করলেন না। একমাত্র হিন্দু মহাসভা জায়গায় জায়গায় প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করল, কিন্তু কংগ্রেসের মতো ব্যাপক জনসমর্থন তাদের ছিল না । 'প্রত্যক্ষ সংগ্রাম'শান্তিপূর্ণভাবে পালন করা হবে, জিন্না ও লীগের উপর এই অগাধ বিশ্বাস স্থাপন করেই গান্ধীজী তাঁর কর্তব্য শেষ করলেন নেহরু তাঁর স্বভাবসিদ্ধ 'বিদ্রোহ' ঢং-এ যাঁরা ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করতে অনিচ্ছুক, তাদের প্রতিদিনের মতোই হাট, বাজার, অফিস করবার পরামর্শ দিলেন ।
লীগের 'প্রত্যক্ষ সংগ্রাম' নিয়ে সবচেয়ে অদ্ভুত বক্তব্য রাখা হল কম্যুনিস্ট পার্টির তরফ থেকে । ১৩ই আগস্ট, ১৯৪৬-এ বঙ্গীয় আইন পরিষদে পার্টির নেতা জ্যোতি বসু (বর্তমানে পঃ বঃ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী) এক প্রচারবিজ্ঞপ্তিতে জানালেন, “মূলতঃ আমাদের পার্টির চেষ্টা হবে মুসলীম লীগের ডাকা বনধূ-এর দিন রাজ্যে শান্তি বজায় রাখা । তাই যেখানে প্রয়োজন সেখানে আমরা বনধূ সমর্থন করব এবং যেখানে প্রয়োজন নয় সেখানে বন্ধর বিপক্ষে থাকব । (with a strike where necessary and without a strike where necessary) কী বিস্ময়কর সুবিধাবাদ! হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে কম্যুনিস্টরা লীগের ডাকা বাংলা বন্ধের বিরোধীতা করবেন । অপরদিকে, মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে বনধ সমর্থন জানানো হবে । ১৬ তারিখ ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই হাওড়া থেকে আসা রহমান আলীর লোকজন হিন্দুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল । লুঠ, খুন, ধর্ষণে মেতে উঠল কলকাতা । হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হল । ধর্ষিতা এবং অপহৃতা মহিলাদের কোন হিসাব পাওয়া গেল না । কলকাতার এখানে সেখানে জমে উঠল লাশের পাহাড় ।
দাঙ্গার বীভৎসতা দেখে স্টেটস্যান পত্রিকায় ব্রিটিশ সংবাদদাতা কিম ক্রিস্টেন লিখলেন,
"দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় আমার স্নায়ু (nerve) যথেষ্ট শক্ত হয়ে গিয়েছে । কিন্তু যুদ্ধও এত পৈশাচিক নয়। এ এক মধ্যযুগীয় বর্বর উন্মাদনা। এবং এটাকে পৈশাচিক রূপ দেওয়া হয়েছিল।”
২৩ কলকাতার মেয়র সেরিফ খান সক্রিয়ভাবে এই দাঙ্গা পরিচালনা করলেন । প্রশাসন প্রত্যক্ষভাবে এই দাঙ্গার মদত যোগাল । আগেই পরিকল্পনা মাফিক পুলিশ প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল করা হয়েছিল । রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তর ছিল মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দীর হাতে । তাঁর নির্দেশে চব্বিশটি পুলিশ হেডকোয়াটার্সের সবকটি থেকেই হিন্দু পুলিশ অফিসার সরিয়ে তাদের জায়গায় বাইশটিতে মুসলমান অফিসার এবং দুটিতে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অফিসার নিয়োগ করা হয়েছিল । ২৫ পুলিশকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করে রাখা হল । সরকার কোন রকম গণ্ডগোলের কথাই অস্বীকার করলেন । এমনকি, বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর এফ.ব্যারােজ তাঁর অফিসের চেম্বারে বসে ঘোষণা করলেন যে তিনি দাঙ্গার কোন খবরই শোনেননি (Seeing no evilhearing no evil)। প্রশাসন হিন্দুদের নিরাপত্তা দেবে না বুঝতে পেরে সতেরো তারিখ বিকাল থেকে হিন্দু ও শিখরা যৌথভাবে অঞ্চলে অঞ্চলে প্রতিরোধবাহিনী গড়ে তুলল । বিভিন্ন জায়গায় মুসলমান সমাজবিরোধীদের উপর পাল্টা আঘাত নামিয়ে আনা হল । কিন্তু বোর আর সরকার নীরব দর্শক রইল না । পুলিশ ও মিলিটারিকে প্রতিরোধ বাহিনীগুলির উপর লেলিয়ে দেওয়া হল । ২৬ কলকাতায় দাঙ্গায় নিহত হল পাঁচ হাজার মানুষ, আহতের সংখ্যা পনের হাজার ছাড়িয়ে গেল । কিন্তু 'প্রত্যক্ষ সংগ্রামে'র নামে যে ঠিক এই রকমই একটা হিন্দু নিধন যজ্ঞের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, মহম্মদ আলি জিন্না তা কখনও গোপন রাখেননি । ২৭-২৮ জুলাই, ১৯৪৬, বোম্বেতে সর্বভারতীয় মুসলীম লীগের জাতীয় সভায় 'প্রত্যক্ষ সংগ্রাম' (Direct Action) কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছিল । জিন্না ঐ সভায় ঘোষণা করেছিলেন "পাকিস্তান বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছুর সাথেই মুসলমান জাতি ('Muslim Nation', জিন্না মুসলমানদের একটি আলাদা জাতি বলে দাবী করতেন) কোন প্রকার আপোস করবে না। এখন সময় হয়েছে সেই দাবী আদায়ের জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া” (Now the time has come for the Muslim Nation to resort to direct action)
এখন কেন এই 'প্রত্যক্ষ সংগ্রামে'র প্রয়োজন? জিন্নাহ ব্যাখ্যা করলেন,
"to achieve Pakistan and assert our just right and to vindicate our honour and to get rid of the present slavery under British and contemplated future of the caste Hindu domination"
এই 'প্রত্যক্ষ সংগ্রামে'র গতিপ্রকৃতি কী হবে? জিন্না দাবী করলেন, "আমরা আজ এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি । মুসলীম লীগের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেআজ পর্যন্ত সবসময়ই আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথেই (Constitutional methods) আমাদের দাবী জানিয়ে এসেছি । কিন্তু আজ সময় এসেছে এই নিয়মতান্ত্রিক পথকে বিদায় জানাবার (good bye to constitutional methods) ।
আমরা এতদিন যে দুটো 'পার্টি'র কাছে দাবী জানিয়ে এসেছি, তারা দু'জনেই আমাদের বুকে পিস্তল চেপে ধরেছে । একজন দেখিয়েছে মেশিনগান আর ক্ষমতার আস্ফালন, অন্যজন দেখিয়েছে সত্যাগ্রহের ভয় । কিন্তু আজ আমাদের কাছেও পিস্তল আছে এবং আমরা তা ব্যবহার করতে সমর্থ । (we also have a pistol and are in position to use it) এই 'পিস্তল' কলকাতায় পরিপূর্ণভাবে সদ্ব্যবহার করা হল । কিন্তু বারুদের গন্ধ মিলিয়ে গেল অচিরেই । বাঙালী হিন্দুর 'ইতিহাস বিস্মৃত' মানসিকতার উপর 'কলকাতা দাঙ্গা' কোন সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করল না । এই রকম একটা জঘন্য অপকর্ম করবার পরও বাংলার মুসলীম লীগ মন্ত্রীসভা কোন সঙ্কটের সম্মুখীন হল না । কংগ্রেস মুসলীম লীগের বিরুদ্ধে কোন রাজনৈতিক আন্দোলন করল না। দিল্লীর মসনদ দখলের স্বপ্ন তখন তাদের সমস্ত শক্তি নিংড়ে নিয়েছিল ।
"While Calcutta was the scene of an unprecedented holocaust Nehru was busy negotiating with the Viceroy about the interim Government."
নোয়াখালির দাঙ্গা: এক পরিকল্পিত গণহত্যা
অঞ্চলে অঞ্চলে হিন্দু প্রতিরোধ বাহিনী গড়বার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে হিন্দু মহাসভার নেতা ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জ্জী বাংলা চষে বেড়াতে লাগলেন । কিন্তু বাঙালীর উন্নাসিক মানসিকতার কাছে তাঁর আহ্বান পরাভূত হল । কিন্তু 'কলকাতা দাঙ্গা'র যন্ত্রণা 'মুসলমান জাতি'র পক্ষে সহজে ভুলে যাওয়া সম্ভব হল না । মুসলীম লীগ মন্ত্রীসভা থাকা সত্ত্বেও হিন্দুরা মুসলমান আক্রমণ প্রতিরোধ করবার সাহস দেখাতে পারে-এই অপমান মুসলমানদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না । সুতরাং হিন্দুদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য শুরু হল নতুন প্রস্তুতি । মুসলমান নেতারা এই বার প্রথম থেকেই সচেতন ছিলেন যেন কলকাতার পুনরাবৃত্তিনা হয় । অর্থাৎ প্রতিরোধ তো দূরের কথা, হিন্দুরা পালিয়ে যাওয়ারও কোন সুযোগ যেন না পায়। আর এর জন্য বেছে নেওয়া হল কলকাতা থেকে দূরে, নদীনালা বেষ্টিত,তাল সুপারির ছায়ায় ঘেরা, শান্ত শ্যামল নোয়াখালি । পূর্ববাংলার এই জেলাটির একটি আবশ্যকীয় গুণ ছিল । জেলাটি হিন্দুসংখ্যালঘু । জনসংখ্যার মাত্র ১৮.৬% হিন্দু, বাকী ৮১-৪%,মুসলমান । তাই কলকাতায় ব্যর্থতার পর পাকিস্তান সৃষ্টির দ্বিতীয় এক্সপেরিমেন্ট এবার এখানেই শুরু হল । শুরু হল 'অপারেশন নোয়াখালি' ।
"হুনছেন নি ও মিঞা ভাই
গোলাম সরোয়ার মিঞার মতন
খাট্টি মাইনস্ আর নাই ।"
গোলাম সরোয়ারকে নিয়ে সেদিন, এ রকম অনেক ছড়া ঘুরছিল নোয়াখালির গ্রামে- গঞ্জে । মুসলিম লীগের প্রাক্তন এম. এল. এ. সাহাপুর স্কুলের সভাপতি গোলাম সরোয়ার তখন নোয়াখালির অবিসম্বদিত নেতা । সাধারণ মানুষের চোখের মণি, যুব সমাজের প্রেরণা । শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার উত্তাপে উদ্বেলিত মুসলমানরা সেদিন গোলাম সরোয়ারকে ছড়া বেঁধে অভিনন্দন জানিয়েছিল নোয়াখালি জেলার গ্রামে-গঞ্জে । 'কলকাতা দাঙ্গা'র প্রতিশোধ নিতে নোয়াখালির হিন্দুদের উপর ব্যাপক সন্ত্রাস নামিয়ে আনতে হবে-এই পরিকল্পনা ছিল গোলাম সরোয়ারের মস্তিষ্ক প্রসূত । এই পরিকল্পনা সার্থক রূপায়ণে গোলাম সরোয়ারকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল স্কুলের শিক্ষক, মৌলভি, এমনকি ইউনিয়ন সভাপতিরাও (Gulam received support from local schoolmasters, moulavis and the union Presidents)
![]() |
গোলাম সরোয়ার হোসেনের বাসভবন ছবি: Wikipedia |
সেপ্টেম্বর মাস থেকে নোয়াখালিতে শুরু হয়েছিল লাগাতার হিন্দু-বিদ্বেষী প্রচার । হিন্দুদের দোকান বয়কট করবার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল মুসলমানদের কাছে । মুসলীম ন্যাশনাল গার্ড-এর ভলান্টিয়াররা হিন্দু দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত যেন কোন মুসলমান সেখান থেকে জিনিস না কেনে। শত প্রয়োজনেও কোন মুসলমান হিন্দুর দোকান থেকে জিনিস কিনলে তাকে প্রকাশ্যে কান ধরে উঠবস করতে হত । সরকার তার গোপন রিপোর্টে জানিয়েছিল,
"Muslims buying goods from Hindus were abused and beaten.
কোর্টে গিয়ে মুসলমানদের কাছে আহ্বান জানানো হত যেন কোনভাবেই তারা হিন্দু উকিলের কাছে না যায় । নোয়াখালিতে বড় বড় পানের মৌজা ছিল । হাটের দিন লীগের কর্মীরা হিন্দুদের পানের আড়তগুলির সামনে পিকেটিং করে থাকত যেন কোনভাবেই হিন্দুরা পান বিক্রি করতে না পারে । এভাবে হিন্দুদের ভাতে মারার সাথে সাথে শুরু হয়েছিল তাদের জীবনের সামান্যতম নিরাপত্তাটুকুও কেড়ে নেওয়া । বেছে বেছে হিন্দুদের বাড়ি ডাকাতি করা, প্রকাশ্য স্থানে গরু জবাই করা ও সেই মাংস হিন্দুদের বাড়ির উপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া, হিন্দুদের মন্দির অপবিত্র করা-এ সবই ছিল গোলাম সরোয়ারের নেতৃত্বে লীগের কাফের শূন্য নোয়াখালি তৈরীর পরিকল্পিত প্রক্রিয়ার অঙ্গ । তৎকালীন বঙ্গীয় আইনসভাতেও বিভিন্ন বক্তা নোয়াখালির হিন্দুদের নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করে জানিয়েছিলেন
"Widespread reports of Hindus deprived of their valuables while travelling in boats, of Hindu houses burgled, of cows sacrificed in public places, of Hindu shops looted and temples and idols desecrated."
১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসের ১০ তারিখ কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার দিন । নোয়াখালীর হিন্দুরা বাড়িতে পূজার আয়োজনে ব্যস্ত । অন্যদিকে মুসলিম লীগ নেতা-কর্মীরা প্রচার করে যে, শিখ সম্প্রদায় দিয়ারা শরীফ আক্রমণ করেছে । গুজবের ফলে আশেপাশের এলাকার মুসলিমরা দলে দলে দিয়ারা শরিফে জড় হয় । গোলাম সরোয়ার হুসেনি সমবেত মুসলিমদেরকে সাহাপুর বাজার আক্রমণ করতে নির্দেশ দেয় । কাশেম নামের আরেকজন মুসলিম লীগ নেতাও তার নিজস্ব বাহিনী নিয়ে সাহাপুর বাজারে পোঁছায়, যাদের কাশেমের ফৌজ বলা হত ।
কাশেমের ফৌজ নারায়ণপুর থেকে সুরেন্দ্রনাথ বসুর ‘জামিদার অফিসের’ দিকে এগিয়ে যায় । কল্যাণনগর থেকে আসা আরেকদল দাঙ্গাবাজ মুসলিম কাশেমের ফৌজের সাথে যোগ দেয় । এদের সাথে আরও অনেক ভাড়া করে আনা মুসলিম গুণ্ডারা জামিদার অফিসে আক্রমণ করে । সামান্য প্রতিরোধের পরই সুরেন্দ্রনাথ বসু ধারাল অস্ত্রের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন । মুসলিম জনতা হাত-পা বেধে তাকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে । সুরেন্দ্রনাথ বসুকে মুসলিমরা আক্রমণ করেছে শুনতে পেয়ে পাশের পাঁচঘরিয়া গ্রামের ডাক্তার রাজকুমার পাল তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন । কিন্তু পথিমধ্যে তাকে মুসলিম দুর্বৃত্তরা ছুরিকাহত করে ।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য
হিন্দুদের জীবন কিভাবে বিভীষিকার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল তা স্মরণ করতে এখনও আঁৎকে ওঠেন বেগমগঞ্জ থানার পাঁচ গাঁও-এর মানুষ ।
"আমাদের পাশেই একটা ব্রাহ্মণ পরিবার ছিল । ওরা ছিল চার ভাই । কুরবানির দিন ওদের ঠাকুর মন্দিরের সামনে গরু কাটা হল, তারপর ঝুড়ি করে ওদের চার ভাইয়ের ঘরেই মাংস পাঠিয়ে দেওয়া হল । ওরা তো এসব দেখে একেবারে আঁৎকে উঠেছে আর কী! অনেকে ঘৃণায় বমি করতে শুরু করল । ব্যাস, আর যায় কোথায় । গ্রামের সমস্ত মুসলমান ওদের বাড়ি ঘিরে ধরল । বলল, 'শালা মালাউন, হারামজাদা,আমাদের খোদার প্রসাদ অপমান করলি!' বিচার বসল, ওদের শাস্তি হল । বাড়ির সব পুরুষকেনাকে খৎ দিতে হল, জরিমানা ধার্য্য হল ২৫০ টাকা ।"
নাউলির গোবিন্দপুর গ্রামের এক বৃদ্ধ সজল চোখে জানিয়েছেন কী বীভৎস মানসিক অত্যাচার তাঁদের সহ্য করতে হয়েছিল । "আমরা দু-তিন জন হিন্দু এক সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছি দেখলেই মুসলমানরা আমাদের টিটকারী দিয়ে ছড়া কাটতঃ
"ওহে পূর্ব পাকিস্তানের বাঁশরি
দেখ, বর্ণহিন্দু কথা কয়
হাত ঠারি, মুখ ঠারি।"
নিজের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে আজকের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত জনৈক আইন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, "আমি তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি । অবাক হয়ে দেখলাম যারা আমাদের বাড়িতে কাজ করত তারা হঠাৎ আমাদের 'তুই' বলে সম্বোধন করতে আরম্ভ করল । কলকাতা থেকে কোন আত্মীয়-স্বজন গেলে বলত, 'কিরে, কলকাতায় ক'টা মুসলমান মারলি' । ওরা ইচ্ছা করেই 'তুই' শব্দটা ব্যবহার করত ।"
সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে লেখা উপরেরর এই অভিজ্ঞতাগুলির মধ্যে ক্ষীণতম সত্যের অপলাপ নেই । ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত Bengal Press Advisory Committee-র রিপোর্টেও হিন্দুদের এই করুণ অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত হয়েছে । ঐ সমস্ত নথিপত্র দেখলে বোঝা যায়,নোয়াখালি 'দাঙ্গা'র মাটি তৈরী করার জন্য কী ধুরন্ধর পরিকল্পনার আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল ।
B. P., A. C. নোয়াখালি জেলার বিভিন্ন থানায় জমা দেওয়া 'ডায়েরী' ঘেঁটে যে তথ্য বের করেছিল তাতে জানা যায় যে হিন্দুরা অনেক আগে থেকেই স্থানীয় প্রশাসনকে দাঙ্গার পূর্বাভাস দিয়েছিল । কিন্তু প্রশাসন ছিল রহস্যজনকভাবে নির্লিপ্ত । থানায় নথিভুক্ত কিছু 'ডায়েরী'র কথা এখানে উল্লেখ করা হল । নিরাপত্তার কারণে ডায়েরীদাতাদের নাম সেদিন B. P., A. C. প্রকাশ করেনি । ফলে এখানেও কোন নাম প্রকাশ করা গেল না। রামগঞ্জ থানায় ১৩-৯-৪৬ এ জনৈক গ্রামবাসী যে 'ডায়েরী' করেন তা এইরকম, "রেশন নিয়ে ফিরবার পথে একদল লোক আমায় আক্রমণ করে । কিন্তু আমার গ্রামের লোক ঐ সময় চলে এলে আমি বেঁচে যাই । কিন্তু যাবার আগে ওরা আমাদের এই বলে শাসায় যে কলকাতার বদলা ওরা নেবেই । আমরা কেউ নিস্তার পাব না ।”
![]() |
দাঙ্গায় আক্রান্ত এক হিন্দু বসতির ছবি |
দাঙ্গার পূর্বপরিকল্পনা
১০-৯-৪৬ এ নোয়াখালির জেলাশাসককে লেখা একটি আবেদন পত্রে কিছু গ্রামবাসী জানিয়েছিলেন, "আমরা (হিন্দুরা) এখানে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি । 'কলকাতা দাঙ্গার বদলা চাই' হুঙ্কার দিয়ে রোজই এখানে মিছিল বের করা হচ্ছে । আমাদের দোকান থেকে জিনিস না কিনবারজন্য বলা হচ্ছে । আমাদের 'জবাই করা হবে' বলে শাসানো হচ্ছে । আমাদেরনিরাপত্তার জন্য গ্রামে সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করা হোক । আমরা, গ্রামবাসীরা গ্রামে পুলিশ রাখবার খরচ বহন করব!" ১৮-৯-৪৬ এ রকমই একটি ডায়েরীতে অভিযোগ করা হয়েছে, "আমাদের জীবন এখানে সুতোর উপর ঝুলছে । আমাদের সবাইকে খুন করা হবে বলে শাসানো হচ্ছে । ওরা বলছে, শুধু হাই কম্যান্ডের নির্দেশ এখনও পাওয়া যায়নি, তাই আমাদের কোতল করা হচ্ছে না ।" শুধু হুমকি দিয়েই হিন্দুমনকে ভয়ক্লিষ্ট করে তোলা হয়নি । হিন্দুদের ধর্মীয় স্থানগুলি অপবিত্র করারও ডাক দেওয়া হয়েছিল ।
১০-৯-৪৬ এ পুলিশের কাছে জমা দেওয়া একটি অভিযোগে দেখা যায় যে গোলাম সরোয়ারের নেতৃত্বে মুসলীমলীগের একটি মিছিল সাম্প্রদায়িক স্লোগান দিয়ে গ্রাম পরিক্রমা করবার পর জনৈক গ্রামবাসীর দেবস্থান অপবিত্র করে । এভাবে একদিকে যখন লাগাতার ত্রাসের সৃষ্টি করে হিন্দুদের মনস্তাত্বিকভাবে ধ্বংস করার চক্রান্ত চলছিল, অন্যদিকে তখন মুসলমানদের ক্ষেপিয়ে তোলা হচ্ছিল ধর্মীয় কুসংস্কারকে সম্বল করে । মৌলভিরা গ্রামেগঞ্জে এমনও প্রচার করেছিল যে, আগামী কিছুদিনের মধ্যেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে এবং এই পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে সমস্ত হিন্দুকে মুসলমান ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে হবে ।
দাঙ্গার পরিকল্পনা এত ব্যাপক ছিল যে বাংলার বাইরে থেকে অবাঙালী পাঠান ও পেশোয়ারী মুসলমানদের এনে নোয়াখালির বিভিন্ন গ্রামে জড়ো করা হয়েছিল । অমৃতবাজার পত্রিকায় রিপোর্ট করা হয়েছিল, "Many of the hooligans in Noakhali appeared to be from outside."
নোয়াখালি থেকে সর্বস্বান্ত হয়ে পালিয়ে আসা যে মানুষগুলি সেদিন কলকাতার বঙ্গ বাসী কলেজের ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদেরই একজন জনৈক ফণিভূষণ শূর জানিয়েছিলেন,
"আমাদের গ্রামে (হাজিগঞ্জ) দাঙ্গার নেতৃত্ব দিয়েছে পেশোয়ারী মুসলমানরা । ওদের প্রত্যেকের হাতে ছিল লম্বা তরোয়াল। ওদের নির্দেশেই খুন, লুঠ, ধর্ষণ, অপহরণ সংগঠিত হয়েছিল ।”
এখানেই শেষ নয় । দাঙ্গার এই নিখুঁত পরিকল্পনাকে আরো নিখুঁতভাবে বাস্তবায়িত করবার উদ্দেশ্যে নোয়াখালির দাঙ্গা পরিচালনার সমস্ত দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মুসলমান সৈন্যদের উপর । সেনাবাহিনীর রণকৌশলের সমস্ত শিক্ষা নোয়াখালির হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। লীগ নেতারা কলকাতা দাঙ্গার চরম প্রতিশোধ নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন । তাই তাঁদের তৃনীরের সমস্ত অস্ত্রই তাঁরা হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতে চাইলেন । দাঙ্গা বিধ্বস্ত নোয়াখালি ঘুরে এসে সাংবাদিকরা জানিয়েছিলেন,
"the heads of miscreants were Ex-servicemen and they organised the raids in military fashion...The people knew how to dig up road and cut communication."
অর্থাৎ পেশাদারিত্বের সার্থক প্রয়োগ করা হল নোয়াখালির দাঙ্গায় । পথের জায়গায় জায়গায় গর্ত খুঁড়ে, কিংবা খাল এবং নদীগুলিতে নৌকার সাহায্যে ব্যারিকেড তৈরী করে আক্রান্ত হিন্দুদের পালিয়ে যাওয়ার সমস্ত পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল । 'হিন্দুরা যেন পালিয়ে যেতে না পারে তাই রাস্তাগুলি খুঁড়ে রাখা হয়েছিল, জলপথে ব্যারিকেড গড়ে তোলা হয়েছিল, এবং যেসব জায়গা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ রয়েছে, সেখানে সশস্ত্র দুস্কৃতিকারীরা পাহারা দিচ্ছিল ।'”
বাংলার লীগ মন্ত্রীসভার প্রধান সুরাবাদী স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন, "Some canals in the affected areas had been damaged and roads cut." এভাবে সমস্ত প্রস্তুতি নেওয়ার পর, ১০ই অক্টোবর, ১৯৪৬, নোয়াখালি দাঙ্গার আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত ঘটল । ভয়াবহ সন্ত্রাস নামিয়ে আনা হল হিন্দুদের উপর । নোয়াখালি ও ত্রিপুরার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে খুন, লুঠ, ধর্ষণ ও অপহরণ চলল বাধাহীনভাবে । প্রশাসন জেগে ঘুমিয়ে রইল । অসহায় আতঙ্কিত হিন্দুরা পালাতে শুরু করল প্রাণ বাঁচাতে। দাঁঙ্গা শুরু হয়েছিল ১০ই অক্টোবর । কিন্তু রাজ্য সরকার দাঙ্গার খবর প্রথম প্রকাশ করল ১৫ই অক্টোবর । অর্থাৎ, দাঙ্গা শুরু হওয়ার পাঁচ দিন পরে, এবং সেটাও যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত আকারে । 'নোয়াখালি দাঙ্গা' সম্পর্কে স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রাথমিক রিপোর্ট লেখা হল,
"বাংলা সরকার প্রাথমিক খবরে জানতে পেরেছে যে নোয়াখালি জেলার দাঙ্গা শুরু হয়েছে । দাঙ্গাকারীরা মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গ্রাম আক্রমণ করছে । গত বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ '১০ই অক্টোবর থেকে এই খুন ও লুঠ শুরু হয় । জোর করে ধর্মান্তরকরণ এবং ধর্মীয় স্থান অপবিত্র করবার খবরও এসে পৌঁচেছে । ব্যাপক হত্যালীলা চলছে । জীবন্ত মানুষকেও পুড়িয়ে মারা হয়েছে । জেলার বার কাউন্সিলের সভাপতি ও তাঁর পরিবারের সবাইকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে ।"
সরকারের এই খবর black out করবার নীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে অমৃতবাজার পত্রিকায় সম্পাদকীয় লেখা হল,
"নোয়াখালি থেকে রক্ত হিম করা খবর আমাদের দপ্তরে এসে পৌঁচেছে । সরকারী ও বেসরকারী উভয়ের বক্তব্য থেকেই এটা পরিস্কার যে, এই দাঙ্গা ছিল পূর্বপরিকল্পিত । পরিকল্পনা অনুসারেই গত বৃহস্পতিবার থেকে খুন ও লুঠ শুরু হয়েছে ।
কিন্তু এটা ভাবতে অবাক লাগছে যে, এই ধরনের এক অভূতপূর্ব দাঙ্গার খবর প্রথম প্রকাশিত হল পনেরই অক্টোবর, অর্থাৎ দাঙ্গা শুরু হওয়ার পাঁচদিন পরে । দুঃখজনকভাবে, অথবা বলা যেতে পারে রহস্যজনকভাবে, বাংলা সরকারের 'Director of Publicity'দ্বারা প্রকাশিত 'press note' এত সংক্ষিপ্ত (Laconic) ছিল যে এর থেকে কোনভাবেই দাঙ্গার ভয়াবহতা সম্পর্কে আঁচ করা সম্ভব নয় । "কিন্তু এই দীর্ঘ পাঁচদিন এভাবে সাধারণ মানুষকে অন্ধকারের রাখবার কৈফিয়ৎ কে দেবে? আর যাই হোক, নোয়াখালি নিশ্চয়ই পেশোয়ার বা কুইট্টা নয় । কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার পথ । তবে কি রাজ্য সরকার জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে এই ক'দিন কোন সংবাদ পায়নি । এবং যদি পেয়ে থাকে তবে রাজ্য সরকার এই ক'দিন কী করেছে?
শুধু খুন বা লুঠ 'নোয়াখালি দাঙ্গা'র মূল উদ্দেশ্য ছিল না । তাই যদি হত তবে দাঙ্গাকারীদের সঙ্গে মোল্লা বা মৌলভির দল হিন্দু গ্রামগুলি আক্রমণ করতে যেত না । এ ছিল ভবিষ্যৎ পাকিস্তান রাষ্ট্রের রূপরেখা কী হবে তার একটা ছোট্ট প্রদর্শন । জেলার সমস্ত হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করে নোয়াখালিকে দার-উল্-ইসলামে পরিণত করতে চেয়েছিলেন লীগের নেতৃবৃন্দ । তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এই বল্গাহীন সন্ত্রাসের । তৎকালীন বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য কংগ্রেস নেতা কামিনী কুমার দত্ত 'নোয়াখালি দাঙ্গা'র উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন,
"that the apparent object behind the disturbances was to make the entire district exclusive to the majority community (Muslim)
নোয়াখালিকে 'দার-উল-ইসলামে' পরিণত করবার জন্য সেখানে একদিকে যেমন খুনলুঠ-সন্ত্রাসের বল্লাহীন রাজত্ব কায়েম করা হল, অন্যদিকে তেমনি বারো থেকে বিয়াল্লিশ অসংখ্য হিন্দু নারী ধর্ষণ বা অপহরণের শিকার হল । ভাগ্যবতী যে ক'জন পালিয়ে আসতে পেরেছিল তাদের চোখেও ছিল মৃত্যুর বিভীষিকা । 'হয় কোরাণ নয় মৃত্যু' নীতি অবলম্বন করে হিন্দুদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হল । এমনকি, তাদের দিয়ে গো-হত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছিল এবং সেই গোমাংস তাদের খাওয়ানো হল । হিন্দুদের সমস্ত ধর্মীয় স্থানগুলি অপবিত্র করাহল ।
দাঙ্গা 'রিপোর্ট' করতে গিয়ে স্টেটস্যান পত্রিকা লিখেছিল,
In an area of about 200 sq miles the inhabitants surrounded by riotous mobs, are being massacred, their houses being burnt, their womenfolk being forcibly carried away and thousands being subjected to forcible conversion, Thousands of hooligans attacked the villages, compelled them (Hindus) to slaughter their cattle and eat. "All places of worship in the affected villages havė been desecrated."
কিন্তু পুলিশ ও প্রশাসন হিন্দু জনসাধারণকে রক্ষা করতে কী ব্যবস্থা নিয়েছিল? ঐ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল যে, নোয়াখালির জেলাশাসক এবং পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট ঐ বর্বরতা বন্ধ করতে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেননি । অবশ্য পুলিশের সদর্থক ভূমিকা পালন করবার কোন প্রশ্নই ছিল না। নোয়াখালি জেলার পুলিশ প্রধান নিজে ছিলেন মুসলীম লীগের পরিকল্পিত এই দাঙ্গার প্রত্যক্ষ মদতদাতা । তাঁর হিন্দুবিদ্বেষ এত প্রবল ছিল এবং মুসলমান দাঙ্গাকারীদের সঙ্গে তিনি এত বেশী ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন যে পুলিশের বিভাগীয় প্রধান তাঁকে ভর্ৎসনা করতে বাধ্য হয়েছিলেন । রাইটার্সবিল্ডিং থেকেও জেলা পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল দাঙ্গার সাথে জড়িত হওয়ার অপরাধে যে সমস্ত লীগ সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাদের যেন ছেড়ে দেওয়া হয় । গোয়েন্দা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল যে,
Support for the rioters from the League Government became apparent when it directed the police to discontinue prosecutions against a large number of those arrested"
দুঃখজনকভাবে উদারপন্থী বলে পরিচিত ফজলুল হকও মুসলমান দাঙ্গাকারীদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য তদ্বির করেছিলেন । ভি পি মেনন 'নোয়াখালি দাঙ্গা' সম্পর্কে লিখেছিলেন,
"It was an organised attack engineered by the Muslim League and carried out with the connivance of the administrative officials."
প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিজ্ঞতা
'আমরা সবাই ইসলামে দীক্ষিত হয়েছি' শিরোনামে পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর ঐ সময় আলোড় সৃষ্টি করেছিল । নোয়াখালি থেকে জনৈক বিভূতিভূষণ দাস কলকাতায় তাঁর ভাই সুধাংশুভূষণ দাসকে একটি চিঠি লিখেছিলেন । ঐ চিঠিটি বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল-
“১০ তারিখ রাতেই আমাদের সকলকে ইসলামে দীক্ষিত হতে বাধ্য করা হয়েছে । ঐ দিন রাতে বিরাট সংখ্যক এক মুসলমান জনতা আমাদের গ্রাম আক্রমণ করে । ওরা আমাদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হবে ভয় দেখিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করে । ওরা আরো বলে যে 'হাই-কমান্ড' নাকি সমগ্র নোয়াখালি জেলাকে 'দার-উল-ইসলামে' পরিণত করতে বলেছে । এই ভাবে ওরা চাটখিল, রামপুর, দাসমেরিয়ার সমস্ত গ্রামবাসীকেও মুসলমান হতে বাধ্য করেছে ।”
ধর্মান্তকরণের পরই নব মুসলমানদের ঐসলামিক নামকরণ করা হত । নামকরণের ব্যাপারে অবশ্য মুসলমানরা খুব সদয় ছিল । ধর্মান্তরিত হিন্দুদের তাদের পছন্দ মত নাম বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হত। যেমন খালিশপাড়ায় প্রিয়ময় চক্রবর্তী নাম নিয়েছিলেন
'মৌলভী হায়দার আলি চৌধুরী ঠাকুর ।' "সদয় মুসলমানরা 'চৌধুরী,ঠাকুর ও মৌলভী প্রভৃতি খেতাব বংশ মর্যাদা ও উচ্চবর্ণের পরিচয় হিসাবের আমাদের দিয়েছিল ।"
নামকরণের পরই হিন্দুদের বাধ্য করা হত গোস্ত খেতে এবং কলমা পড়তে । প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের তিক্ত অভিজ্ঞতা এখনও স্পষ্ট মনে রেখেছেন তেতুঁইয়া বাবুপুর গ্রামের দেবেন্দ্র কুমার নাথ ।
"কানে আঙুল দিয়ে মাথায় রুমাল বা গামছা দিয়ে আমরা কলমা পরতাম- "কলমা তোয়ুব লাহে লাল্লা ইল্লালাহ মহম্মদের রসুলাল্লা।"
কিন্তু এত করেও খাঁটি মুসলমান হওয়া সম্পূর্ণ হত না যতক্ষণ না ধর্মান্তরিত হিন্দুদের বাড়ির মেয়েকে মুসলমানরা বিয়ে করত ।
"আমাদের পাশের গ্রামে এক ভদ্রলোকের ছয় বছরের একটি মেয়েকে 'কলমা'পড়িয়ে একটি মুসলমান ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল হিন্দুরা যে মুসলমান হয়ে গেছে এটা প্রমাণ করাই ছিল এই বিয়ের উদ্দেশ্য,”
জানিয়েছিলেন বেগমগঞ্জ থেকে পালিয়ে আসা উত্তম বসু ।
হাজিগঞ্জ থেকে উদ্ধার পাওয়া জনৈক ভুক্তভোগী তাঁর করুণ অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন,
“ওরা বলল আমাদের বাড়ির মেয়েদের ওদের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে।আমার মামাতো বোন দেখতে খুব সুন্দরী ছিল । দেখলাম অনেকেরই চোখ ওর দিকে । গ্রামের লীগের প্রেসিডেন্ট মামার কাছে ওকে বিয়ে করবার প্রস্তাব দিল। মামারও না বলার কোন উপায় ছিল না । ঐ মুসলমান লোকটি তখন ষাটের ঘরে । আমার মামাতো বোন মাত্র পনের । আমরা সবাই মিলে অনেক পরামর্শ করবার পর ঠিক হল যে আমিই আমার মামাতো বোনকে বিয়ে করব । সেইমত মৌলভীকে জানালাম যে ইসলাম ধর্মে মামাতো বোনকে বিয়ে করতার বিধান আছে, এবং আমরা সবাই মুসলমান হয়ে গেছি । ভাগ্যগুণে উনি রাজী হয়ে গেলেন । সাতদিন আমরা স্বামী-স্ত্রীর অভিনয় করলাম । পরে মিলিটারি গিয়ে আমাদের উদ্ধার করে ।”
এত দুঃখ বেদনার মধ্যেও কিছু কিছু মজার ঘটনা ঘটে যেত যার কথা ভাবলে এখনও হাসিতে ফেটে পড়েন সেদিনের ভুক্তভোগী হিন্দুরা ।
"আমরা তো মুসলমান হয়ে গেলাম। ওরা বলল, 'তোমরা মুসলমান হয়ে গেছ ঠিকই, কিন্তু গোস্ত তো খাওনি। তবে তোমাদের গোস্ত খাওয়ার অভ্যাস নেই, তাই আগে আমরা একসাথে সিন্নী খাব, তারপর গোস্ত খাওয়া হবে' । আমরা প্রায় হাজার দুই লোক একসাথে সিন্নী খেতে বসেছি, এমন সময় কে এসে খবর দিল 'শিখ' এসেছে । পূর্ববাংলার মুসলমানরা শিখদের খুব ভয় পেত । বিশেষ করে কলকাতা দাঙ্গার সময় শিখরা যে বিক্রম দেখিয়েছিল, সে কথা তখন গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে গেছে । 'শিখ আসছে' এই কথা শুনেই মুসলমানরা 'আল্লা হো আকবর' ধ্বনি দিয়ে অন্যান্য মুসলমান গ্রামগুলিকে সতর্ক করে পালিয়ে যেত । যাইহোক, সেদিন শিখ আসছে শুনেই মুসলমানরা বলতে শুরু করল, তোমরা কেউ মুসলমান হওনি । তোমরা সব হিন্দুই আছ । আর তারপর দৌড় । আসলে কি হয়েছিল, চৌমহানী স্টেশনে এক ওয়াগন লোহার রড (rod) এসেছিল । পূর্ববাংলার লোকেরা রডকে বলে 'শিক' । সেই কথাটাই মুখে মুখে রটে যায় যে 'শিখ' এসেছে ।"
সমগ্র নোয়াখালি জেলাকে 'দার-উল-ইসলাম'-এ পরিণত করতে প্রয়োজন ছিল হিন্দু সমাজের শিরদাঁড়াটা ভেঙে দেওয়া । তাই দাঙ্গাকারীরা প্রথমে তাঁদের উপরই আঘাত হানল 'যাঁরা সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে হিন্দু সমাজের অগ্রগণ্য । ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সন্ন্যাসী স্বামী ত্র্যম্বকানন্দ তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যেভাবে বর্ণনা করেছিলেন তা এরকম-
“১০ই অক্টোবর বেগমগঞ্জ বাজার এলাকায় মুসলীম লীগের একটি সভা চলছিল । সভায় প্রধান বক্তা ছিলেন গোলাম সরোয়ার । সভায় প্রায় পনেরো হাজার শ্রোতার সামনে তিনি তীব্র হিন্দু বিদ্বেষী বক্তব্য রাখেন । সেখানে থানার দারোগা নিজে উপস্থিত ছিলেন । কিন্তু তাঁর সামনেই এসব চলতে থাকে। সভা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তেজিত জনতা বাজারে হিন্দু দোকানগুলি আক্রমণ করে । লুঠ করবার পর সেগুলিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় । এরপর জনতা আলাদা আলাদা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে তিনদিকে ছড়িয়ে পড়ে ।
"এমনই একটি দল স্থানীয় জমিদার সুরেন্দ্র কুমার বোসের বাড়ি আক্রমণ করে । তাঁকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় । এরপর জনতা সুরেন্দ্রবাবুর কাছারি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় । সেই সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে পালিয়ে আসা অনেক হিন্দুনারী ও শিশু ঐ কাছারি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল । তাদের অনেকেই আগুনে জ্যান্ত দগ্ধ হয়ে মারা যায় । যারা কোনোক্রমে এই জতুগৃহ থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল, তাদেরও কুপিয়ে হত্যা করা হয় ।
"অপর একটি দল নোয়াখালির District Bar-এর সভাপতি রাজেন্দ্রলাল রায়ের বাড়ি (করপাড়া গ্রাম) আক্রমণ করে । কিন্তু সেখানে স্থানীয় হিন্দুরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করলে দাঙ্গাকারীরা পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয় । বাধা পেয়ে ওরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং আশেপাশের হিন্দুগ্রামগুলিতে আক্রমণ চালায় । হিন্দুদের দেবস্থানগুলির পবিত্রতা নষ্ট করে । ইতিমধ্যে রাজেন্দ্রলাল রায় বেগমগঞ্জ থানায় লিখিত অভিযোগ জানান এবং দ্রুত পুলিশী নিরাপত্তা দাবী করেন । কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ প্রশাসনিক কোন সাহায্যই তিনি পাননি ।"
"পরদিন সকাল আটটায় এক বিরাট জনতা মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাজেন্দ্রলাল রায়ের বাড়ি আক্রমণ করে । কিন্তু রাজেন্দ্রবাবু গুলি চালিয়ে আক্রমণকারীদের হটিয়ে দেন । এভাবে পর পর তিনবার দাঙ্গাকারীরা পিছু হটে যেতে বাধ্য হলেও চতুর্থবার তারা সফল হয় । মুসলীম লীগের প্রাক্তন এম. এল. এ. গোলাম সরোয়ারের নির্দেশে আক্রমণকারীরা প্রথমেই রাজেন্দ্রলাল রায়কে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে । এরপর তাঁর পরিবারের সবাইকে এবং সবশেষেতাঁর বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের হত্যা করা হয় ।"
(অমৃত বাজার পত্রিকা, ২২/১০/১৯৪৬) স্টেটসম্যান পত্রিকার জনৈক সাংবাদিক নোয়াখালীর দাঙ্গা বিধ্বস্ত অঞ্চলে রিপোর্ট করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতার সম্মূখীন হয়েছিলেন তা মধ্যযুগীয় মুসলমান শাসন ব্যবস্থা বা ইসলাম প্রতিষ্ঠাও ততপরবর্তী কালের আরব ইরান ও অন্যান্য অঞ্চলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় । তিনি স্টেটসম্যান পত্রিকায় তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিলেন এভাবেঃ
"নোয়াখালীর রামগঞ্জ থানার একটি বাচ্চা মেয়ে আমাকে এই ঘটনাটি বলেছিল । ১০ ই অক্টোবর সকালে একদল লোক ঐ মেয়েটির বাড়িতে এসে মুসলীম লীগের তহবিলে পাচ শ টাকা চাঁদা চায় । চাঁদা না দিলে বাড়ির সবাইকে খুন করা হবে বলে ওরা হমকি দেয় । প্রাণের ভয়ে মেয়েটির বাবা ওদের পাচশ টাকা দেন । এর কিছুক্ষন পর আবার ওরা আসে, সঙ্গে এক বিরাট জনতা । ঐ বাড়ির জনৈক অভিভাক, যিনি আবার পেশায় মোক্তার, ঐ উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করতে এগিয়ে যান, কিন্তু তিনি কোন কথা উচ্চারণ করবার আগেই তার মাথাটা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে । এরপর গুণ্ডারা পরিবারেরে সবচেয়ে বয়স্ক লোকটিকে (মেয়েটির দাদু) খুন করে । এবার মেয়েটির বাবার পালা, মেয়েটির বাবাকে তারাই সদ্য খুন হওয়া বাবার মৃতদেহের উপর শুইয়ে দেওয়া হল । তখন মেয়েটির ঠাকুরমা তার ছেলেকে বাচাবার জন্য ছেলের দেহের উপর ঝাপিয়ে পড়েন এবং ওদের কাছে ছেলের প্রাণভিক্ষা চাইতে থাকেন । কিন্তু তাতে ওরা ক্ষুদ্ধ হয়ে ঐ মহিলার মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করে এবং তার অচৈতন্য দেয় দূরে ছুড়ে ফেলে দেয় । এবার আবার ওরা মেয়েটির বাবাকে মারতে উদ্যেগী হয় । মেয়েটি ভয়ে এতক্ষণ ঘরের কোণে লুকিয়ে ছিল । বাবার প্রাণ বাচাবার জন্য সে তখন ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এবং ঐ ঘাতকের হাতে গহনা ও চারশ টাকা দিয়ে তাকে কাকুতি মিনতি করে আর বাবাকে না মারবার জন্য । ঐ ঘাতক তখন বা হাতে মেয়েটির কাছ থেক গহনাগুলি গ্রহন করে এবং সঙ্গে সঙ্গেই ডান হাতের দা দিয়ে মেয়েটির বাবার মাথা দেহ থেকে আলাদা করে ফেলে ।"
(দি স্টেটসম্যান, ২৬/১০/১৯৪৬)
নোয়াখালী দাঙ্গার ভয়াবহতা আমাদের সামনে স্পষ্ট করে দেয় যে ভারতীয় মুসলিমদের একাংশের মানসিকতা কেবলমাত্র সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা ও হিংস্রতায় গঠিত ছিল । তাদের হাতে ধর্ম ছিল কেবল ধ্বংসযজ্ঞের অজুহাত, মানবতা নয় । নারী ধর্ষণ, মন্দির ভাঙচুর, হিন্দুদের জোরপূর্বক ইসলাম গ্রহণ করানো । এসব তাদের অন্তর্নিহিত আসুরিক মনস্তত্ত্বের নগ্ন প্রকাশ । সত্যিই, এই দাঙ্গা প্রমাণ করেছে যে যখন ধর্মান্ধতা অন্ধ উন্মাদনায় রূপ নেয়, তখন মানুষ পশুকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে নিষ্ঠুরতায় ।
নোয়াখালী দাঙ্গা তাই শুধু একটি স্থানীয় ঘটনা নয়; এটি ভারতীয় মুসলিম সমাজের ভেতরকার এক ভয়াবহ মানসিক সন্ত্রাসের চিত্র, যার ভয়ালতা আজও ইতিহাসে রক্তাক্ত ছাপ রেখে গেছে ।