শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপূজা ও তার নেপথ্যের ইতিহাস

0

শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপূজা ও তার নেপথ্যের ইতিহাস

Table Of Content (toc)

শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপূজার ইতিহাস

উত্তর কলকাতার বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজার কথা ভাবলে প্রথমেই মাথায় আসে শোভাবাজার রাজবাড়ির নাম । এই রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠা করেন রাজা নবকৃষ্ণ দেব । আচ্ছা, রাজা নবকৃষ্ণকে আপনারা চেনেন তো? তিনি ছিলেন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর একজন নিমক-কালেক্টর, পরে কটকের দেওয়ান । কিন্তু তাঁর বাবা রামচরণ মারা যাওয়ার পর তাঁর বিধবা মা তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়েকে নিয়ে কলকাতার কাছে গোবিন্দপুর অঞ্চলে (এখন যেখানে ফোর্ট উইলিয়াম) পালিয়ে আসেন । মা-এর উৎসাহে নবকৃষ্ণ ইংরেজি, ফারসি ও আরবি শিখলেন । এই বিদ্যার জোরে তিনি প্রথমে ওয়ারেন হেস্টিংসের ফারসি শিক্ষক হলেন, আর তারপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুনশির পদ লাভ করলেন ।

​লর্ড ক্লাইভের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিও তাঁর কাছের লোক হয়ে উঠলেন । সিরাজের বিরুদ্ধে পলাশীর যুদ্ধে রাজবল্লভ, কৃষ্ণচন্দ্র, মিরজাফর ও জগৎশেঠদের সঙ্গে নবকৃষ্ণও ছিলেন । ভাবা যায়, সেই সময়ের এক সাধারণ মানুষ তাঁর বুদ্ধি আর যোগ্যতাবলে কত বড় জায়গায় পৌঁছেছিলেন!

​রাজার পূজা নাকি কোম্পানি পূজা?

​পলাশীর যুদ্ধের পর চারিদিকে তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জয়জয়কার । এই বিজয়কে উদযাপনের জন্য রাজা নবকৃষ্ণ কলকাতার শোভাবাজার অঞ্চলে একটি প্রাসাদোপম বাড়ি কেনেন । সেই প্রাসাদের সঙ্গে তিনি তৈরি করালেন দেওয়ানখানা, নাচঘর, লাইব্রেরি, নহবতখানা এবং একটি বিশাল সাত খিলানের ঠাকুরদালান । যুদ্ধজয়ের স্মারক হিসাবে তিনি ওই বছরেই ওই দালানে দুর্গাপূজা শুরু করলেন । কলকাতার মানুষজন প্রথম দেখল, দুর্গাপূজা মানে শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটা একটা মহোৎসব!

​রাজা নবকৃষ্ণই প্রথম ব্যক্তি, যিনি দুর্গোৎসবে সাহেবদের নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এলেন । আমন্ত্রিতের তালিকায় ছিলেন স্বয়ং লর্ড ক্লাইভ । উপলক্ষ ছিল পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সংবর্ধনা দেওয়া । ক্লাইভ হাতির পিঠে চেপে এই বাড়ির পূজা দেখতে এসেছিলেন । শোনা যায়, সপ্তমীর সকালে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে পাঠানো ‘স্কচ হাইল্যান্ড ব্যান্ডে’র সঙ্গে গঙ্গাস্নানে গিয়েছিল নবপত্রিকা । পুজো দেখিয়েই যে ক্লাইভ ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের তুষ্ট করা যাবে না, সে কথা নবকৃষ্ণ ভালোই জানতেন । তাই সাহেবদের তুষ্ট করতে তিনি এলাহি খানাপিনা আর আমোদ-প্রমোদের আয়োজন করেছিলেন । পুজোর তিন দিন গভীর রাত পর্যন্ত চলেছিল সে খানাপিনা আর ভোজ । আর বাঙালির জন্য ছিল যাত্রাপালা, তর্জা আর কবিগান ।

​ঠাকুরদালানে সাহেব থেকে সন্ন্যাসী

​শোভাবাজার রাজবাড়ির এই ঠাকুরদালান যে কত ঘটনার নীরব সাক্ষী, তা ভাবলে অবাক হতে হয় । রবার্ট ক্লাইভ, ওয়ারেন হেস্টিংস এর মতো ব্রিটিশ শাসক থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, এমনকি গান্ধীজির মতো মনীষীদেরও পদধূলি পড়েছে এই রাজবাড়িতে ।

​এক সময় পুজোর সময় রাজবাড়ির আঙিনা ভরে উঠত কবিগান, তর্জা, খেলাঘর ও বাই-নাচের আসরে, আর বাইরে বসত জমজমাট মেলা । সে কালে এই পুজোয় আমন্ত্রিত পাদ্রী ওয়ার্ড সাহেব লিখেছিলেন, “চক্মিলান প্রাসাদের মাঝখানে উৎসব প্রাঙ্গণ । সামনে পূজা মণ্ডপ । পূর্বদিকের একটি ঘরে সাহেবিখানার বিপুল আয়োজন । হিন্দু নর্তকীদের নাচ গান চলছে । চারদিক ঘিরে কোম্পানির বাঘাবাঘা সাহেব-মেম অতিথিরা কৌচে বসে মৌজ করে তা দেখছেন ।” যদিও দেব পরিবার এই তত্ত্বের সঙ্গে পুরোপুরি সহমত নন ।

শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপূজা ও তার নেপথ্যের ইতিহাস

বড়তরফ ও ছোটতরফ: দুই ভাগে এক ঐতিহ্য

​রাজা নবকৃষ্ণের সাত রানির কোনো সন্তান ছিল না । তাই তিনি দাদার ছেলে গোপীমোহনকে দত্তক নেন । কিন্তু ১৭৮২ সালে তাঁর সপ্তম স্ত্রীর গর্ভে রাজকৃষ্ণের জন্ম হয় । আর এই কারণেই নবকৃষ্ণের সম্পত্তি দু’ভাগ হয়ে যায় । নবকৃষ্ণের আদি বাড়ির বিপরীতে রাজকৃষ্ণের জন্য তৈরি হয় নতুন এক প্রাসাদ । সেখানে ১৭৯২ সাল থেকে আদি বাড়ির রীতি-রেওয়াজ মেনেই দুর্গাপূজা শুরু হয় । এখন শোভাবাজার রাজবাড়ির পূজা দুটি শাখায় পালিত হয় । বড়তরফ এবং ছোটতরফ 

​বড়তরফ: এখানে গোপীমোহন দেবের বংশধরেরা ঐতিহ্যবাহী ঠাকুরদালানেই প্রতিমা স্থাপন করেন ।

ছোটতরফ: রাজকৃষ্ণ দেবের বংশধরেরা এখানে সনাতনী রীতি মেনে পূজা করেন ।

​তবে সেই প্রথম থেকে যে নিয়ম আর আচার-অনুষ্ঠান রাজবাড়িতে শুরু হয়েছিল, আজও তা অব্যাহত ।

​প্রতিমার সাজসজ্জায় আধুনিকতার ছোঁয়া

​এই বাড়ির প্রতিমা একচালা রীতিতে তৈরি হয় । দেখলে মনে হবে যেন এক টুকরো পুরনো ছবি জীবন্ত হয়ে উঠেছে । সিংহের রূপ অনেকটা ঘোড়ার মতো, কার্তিকের সাজে থাকে ইউরোপীয় ছোঁয়া, আর দেবীর অলঙ্কারে মুঘল-নবাবি আভিজাত্য । প্রতিমার মুখাবয়ব আজও তৈরি হয় পূর্বপুরুষদের ছাঁচে, আর একই কারিগর পরিবার প্রজন্ম ধরে এই দায়িত্ব পালন করে আসছে । এই নিষ্ঠা আর ঐতিহ্য দেখে সত্যিই মন ভরে যায় ।

​বিসর্জনের সেই নীলকণ্ঠ পাখির গল্প

​দশমীর দিন বিসর্জন ছিল এক দেখার মতো ব্যাপার । প্রতিমা কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হতো হুগলির ঘাটে । তারপর মাঝনদীতে নৌকায় গিয়ে বিসর্জন দেওয়া হতো । দেবী রওনা হওয়ার সময় একটি নীলকণ্ঠ পাখি ছেড়ে দেওয়া হতো, আর নৌকা ছাড়ার সময় একটি । প্রচলিত বিশ্বাস ছিল, নীলকণ্ঠ পাখি কৈলাসে মহাদেবকে মায়ের রওনা হওয়ার খবর দেবে । আগে আরামবাগ থেকে সত্যিকারের পাখি আনানো হতো । কিন্তু বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন লাগু হওয়ার পর থেকেই নীলকণ্ঠ পাখি ছাড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে । এখন রীতি অনুযায়ী মাটির তৈরি নীলকণ্ঠ পাখি গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয় ।

​এই বাড়ির রীতি অনুযায়ী দশমীর দিন সকালেই মায়ের বিসর্জন হয় । প্রতিমার সামনে একটি বড় হাঁড়িতে জল ভর্তি থাকে । ওই জলের ভেতর মায়ের পায়ের প্রতিবিম্ব দেখে বাড়ির সবাই প্রণাম করেন । ওই সময় বিষাদের সুর বেজে ওঠে সানাইয়ে । বিকেলে শোভাযাত্রা করে গঙ্গায় প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয় । এই দৃশ্যটি সত্যিই অভূতপূর্ব । দুটি নৌকার মাঝে প্রতিমা রাখা হয় । মাঝনদীতে পৌঁছে নৌকা দু’টি ধীরে ধীরে সরে গেলে মাতৃমূর্তি জলে পড়ে যায় ।

​সবশেষে, গত বছর বনেদি বাড়ির পূজা দেখতে গিয়ে এই রাজবাড়িতেও যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল । আমরা কয়েকজন মিলে গিয়েছিলাম, আর ঠাকুরদালানের ভেতরে দাঁড়িয়ে সত্যিই মনে হচ্ছিল, ইতিহাস যেন নিঃশব্দে কথা বলছে ।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
Post a Comment (0)
To Top