নার্সিসাস: যে যুবক নিজের প্রতিচ্ছবির প্রেমে পড়ে প্রাণ হারায়!

0
নার্সিসাস: যে যুবক নিজের প্রতিচ্ছবির প্রেমে পড়ে প্রাণ হারায়!

গ্রীক পুরাণ শুধু দেবদেবীর যুদ্ধ, অলৌকিক ক্ষমতা আর অভিশাপের গল্প নয় । এটি মানুষের মনোজগত, আবেগ আর সম্পর্কেরও প্রতিফলন । ইকো ও নার্সিসাসের কাহিনী সেই দিক থেকেই অনন্য । একদিকে আছে ইকোর প্রেম, যেটি প্রতিধ্বনির মতো ব্যর্থ; অন্যদিকে আছে নার্সিসাসের আত্মপ্রেম, যা শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় । এই গল্প শুধু প্রেমের নয়, বরং মানবজীবনের অহংকার, আত্মপ্রেম, প্রত্যাখ্যান এবং বেদনাময় পরিণতির চিরন্তন প্রতীক ।

ছোটবেলায় গ্রীক পুরাণ সম্পর্কে আমার আগ্রহের শেষ ছিল নাহ । প্রত্যেকটা চরিত্র আমাকে ভাবাতো । এখনো মাঝেমধ্যে সময় পেলে পড়ে ফেলি গ্রীক পুরাণ সাহিত্য! এখন থেকে ডিসিশন নিয়েছি, ওয়েবসাইটে শুধু ধর্মীয় কন্টেন্ট নয়, পুরাণ, সঙ্গীত, ইতিহাস, সাহিত্য, ক্রাইম ইত্যাদি ইন্টারেস্টিং বিষয় নিয়েও লেখালেখি করব । কি বলেন আপনারা?

ইকো ও নার্সিসাস: গ্রিক মিথোলজির এক অমর প্রেমের করুণ গাথা

একসময় ইকো (Echo) শুধুই 'ইকো' বা 'প্রতিধ্বনি' ছিল না। আজ থেকে বহুকাল আগে সে ছিল প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা উচ্ছল এক সদালাপী সুন্দরী তরুণী। গ্রীস এবং রোমের মানুষের বিশ্বাস, ইকো ছিল গল্পের রানী। বনের পরী। কথার মালা গেঁথে উপহার দিত দেবতাদের। বনের পথে, গাছের ছায়ায়, নদীর কূলে ইকোর অবাধ বিচরণ।

শুধু সখীরা কেন, স্বর্গের দেবদেবীরাও মুগ্ধ হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প শুনত ইকোর কাছে বসে। আর দেবরাজ জিউস বনের পরী ইকোকে এত ভালোবাসতেন যে অলিম্পাসের রাজসিংহাসনে তাঁর দেখাই পাওয়া যেত না। ছদ্মবেশে ইকোর পাশে বসে মজার মজার গল্প শুনতেন জিউস।

ইকোর করুণ অভিশাপ: নীরবতার বেদনা

স্বর্গের রানী হেরা সবসময় জিউসের উপর নজর রাখতেন। হেরা যখন জানতে পারলেন যে ইকো কথার বেড়াজালে জিউসকে বন্দী করে তাঁর মন ভুলোনোর চেষ্টা করছে, ক্রোধে অন্ধ হলেন। ইকোকে অভিশাপ দিলেন হেরা—...যে কথার জোরে তুমি পৃথিবীর তাবৎ মনুষ্যসম্প্রদায় এমনকি স্বর্গের দেবতাদেরও মনোরঞ্জনের কারণ হয়ে আছো, আমি তোমার সেই সকল কথার উৎসস্থল জিহ্বাটি কেড়ে নিলাম। কোনো নতুন কথা তোমার মুখে ফুটবে না আর। কেবল মনুষ্য-উচ্চারিত সকল কথার শেষ শব্দটুকুর প্রতিধ্বনি হবে তোমার কণ্ঠ থেকে। হেরার এমন ভয়াবহ অভিশাপ বজ্রাঘাতের মতো নেমে এলো ইকোর মাথার উপর । নিদারুণ শোকে মূর্ছা গেল সুন্দরী ইকো। দেবরাজ্ঞী ফিরে গেলেন স্বর্গের পথে।

আরো জানুনঃ আফ্রোদিতি - সৌন্দর্য, প্রেম এবং ট্র্যাজেডির গ্রিক দেবী

হতভাগিনী ইকো! আজ সে শুধুই প্রতিধ্বনি।

সখীরা অনেক কষ্টে জ্ঞান ফেরাল ইকোর। কিন্তু ইকো তখন বদলে গেছে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে তাদের মুখের দিকে। সবার কথা শুনে যায়। মুখ দিয়ে তার কোনো কথাই সরে না। সখীরা চিৎকার করে তাকে কথা বলতে বলে। কিন্তু ইকোর গলা দিয়ে গোঙানির মতো বেরিয়ে আসে শুধু তাদেরই কথার প্রতিধ্বনি। নিরাশ হয়ে সখীরা সবাই ফিরে যায়। বোবা ইকোর কাছে থাকতে চায় না কেউ। কথা বলার যাদুদণ্ডটি হারিয়ে সাথীহারা ইকো লজ্জায় গহণ বনের অন্তরালে মুখ লুকোয়।


নার্সিসাসের জন্ম ও নিয়তি: এক অভিশপ্ত দৈববাণী

সেই বনেই থাকতেন নদীমাতা লিরিয়োপে। তাঁর একটি মাত্র ছেলে নার্সিসাস। নার্সিসাসের জন্ম হবার কিছুদিন পরে লিরিয়োপে দেবী অ্যাফ্রোদিতি-র মন্দিরে গেলেন ছেলের ভবিষ্যৎ জানবার জন্য। দৈববাণী শুনলেন—ছেলে দীর্ঘজীবী হবে যদি সে কোনোদিন নিজেকে না জানতে পারে। দৈববাণী হেঁয়ালীভরা। কিছুই বুঝলেন না লিরিয়োপে। ছেলের অজানা ভবিষ্যতের আশঙ্কায় দুরু দুরু বক্ষে ফিরে এলেন ঘরে।

বেড়ে চলল নার্সিসাস। উচ্ছল, উদ্দাম। সিক্ত মাটিতে দূর্বাদল যেন বেড়ে ওঠে। যেমন বেড়ে ওঠে বনের ছায়ায় হরিণশিশু। ঘৃতাহুতি দিলে আগুন যেমন দাউ দাউ বেড়ে যায়। মায়ের দুর্বল চিও শান্ত হল ছেলের অবাধ বেড়ে ওঠা দেখে। শিশু থেকে তরুণ নার্সিসাস। মায়ের দু হাতের বন্ধন ডিঙিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে বনের পথে। হাতে তার তীর ধনুক। শিকারী তরুণ। ছায়াঘেরা বনের আঁধার নার্সিসাসের রূপের আলোয় মিলিয়ে যায়। তার শরীরের নিখুঁত গড়ন দেবশিল্পী হেফাস্টাসের শিল্পকলাকেও হার মানায়। পুরুষের এমন রূপ কে কবে দেখেছে! চপল হরিণশিশুর পিছুধাওয়া করতে করতে নার্সিসাস একদিন গভীর বেনে প্রবেশ করল। এই সেই বন যেখানে সুন্দরী ইকো ঠাঁই নিয়েছিল কণ্ঠস্বর হারাবার পর থেকে। ওক গাছের নিভৃত কোটর থেকে ইকো নার্সিসাসকে দেখে ফেলল! সমস্ত হৃদয় দুলে উঠল ইকোর।


প্রতিধ্বনি ও প্রতিবিম্ব: ভালোবাসার এক বিয়োগান্তক পরিণতি

ভালোবেসে ফেলল সে নার্সিসাসকে! দু চোখ ভরে দেখল। দেখে দেখে মন ভরল না ইকোর। নিঃশব্দে অনুসরণ করে চলল নার্সিসাসকে। বার বার সে কথা বলতে চাইল কিন্তু পারল না। কন্ঠ তার রুদ্ধ হয়ে গেছে সেই কবে থেকে। মনে নেই!

কোনোরকমে নিজেকে আড়াল করে নার্সিসাসের পিছু পিছু চলল ইকো। বনের লতা জড়িয়ে ধরল তার পা। বে-খেয়ালে শুকনো পাতায় শব্দ উঠল খস্ খস্। সচকিত নার্সিসাস পিছন ফিরল। কারোর দেখা পেল না। কিন্তু তার বারবারই মনে হল অলক্ষ্যে থেকে কেউ যেন তাকে অনুসরণ করে চলেছে। বিরক্ত হয়ে চিৎকার করে উঠল নার্সিসাস-কেউ আছো কি এখানে? সঙ্গে সঙ্গে ইকোর কন্ঠ থেকে বেরিয়ে এল নার্সিসাস উচ্চারিত শেষ শব্দটি-এখানে!

ইকোর হৃদয় আকুলি বিকুলি করছিল নার্সিসাসের সঙ্গে কথা বলবার জন্য। পারল না। নার্সিসাসের কথার জবাবটুকুও বের হল না তার কন্ঠ থেকে। স্পষ্ট গলার স্বর শুনতে পাবার পরও কারুর দেখা না পেয়ে নার্সিসাসের কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। সে এবার দ্বিগুণ চিৎকার করে বলল-কে আছো, কাছে এসো। এবারও শুনল ছোট্ট উত্তর--এসো! আশ্চর্য! নার্সিসাস ভেবে পেল না। বিস্ময়াহত নার্সিসাস পাগলের মতো একের পর এক প্রশ্ন করে চলল গলা ফাটিয়ে। প্রত্যেক বারই অদৃশ্য নারীকণ্ঠ থেকে সংক্ষিপ্ত জবাব এল তার কানে। ঝোপঝাড়, ডালপালা সরিয়ে আতিপাতি খুঁজে চলল নার্সিসাস। তবুও দেখা দিল না ইকো। ভয় হয়, পাছে নার্সিসাস তাকে প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু নার্সিসাসের প্রশ্নের উত্তর দেবার লোভ সামলাতে পারে না ইকো। এমনই তার অভিশপ্ত জীবন।

অবশেষে ক্লান্ত হয়ে পড়ে নার্সিসাস। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। গভীর অরণ্যের মধ্যে অপরিচিত, অদৃশ্য কন্ঠস্বরের কুহেলিকা ভেদ করার জন্য আকুল স্বরে বলে ওঠে নার্সিসাস- কে তুমি অলক্ষ্যে থেকে আমায় অনুসরণ করছো জানি না। আমি পথশ্রমে অত্যন্ত ক্লান্ত। তুমি কি আমার দৃষ্টিতে শান্তি এনে দিতে পারো না?

এমন করুণ আবেগপূর্ণ আর্তস্বর শুনে আর অলক্ষ্যে থাকতে পারল না ইকো। বেরিয়ে এল গাছের কোটর থেকে নার্সিসাসের সামনে। আবেগে জড়িয়ে ধরল গলা। হাতমুখ নেড়ে ভালোবাসা জানাল। কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরিয়ে এল না ইকোর। কারণ বিস্ময়ে নার্সিসাস নিজেই তো হতবাক। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই সোজা হয়ে দাঁড়াল নার্সিসাস, অপরিচিতা বাকশক্তিহীন দুর্বল নারীর এতোটা বাড়াবাড়ি সহ্য হল না তার। দু হাতে সরিয়ে দিল ইকোকে। গটগট হেঁটে চলল, ফিরেও তাকাল না পিছন দিকে একবার ।


অতলস্পর্শী বেদনা: ইকোর অবসান

হতভাগিনী ইকো। এমন অপ্রত্যাশিত কঠোর ব্যবহারে অভিমানে তার সমস্ত হৃদয় ভরে গেল। ভালোবাসার মৃত্যু হল বুকভরা বেদনায়। এবার সে হাড়ে হাড়ে টের পেল দেবরাজ্ঞী হেরার অভিশাপে তার জীবন সত্যিই অভিশপ্ত। এ জীবনের কোনো দাম নেই আর-না তার নিজের কাছে, অন্য কারও কাছে তো নয়ই। ব্যর্থ জীবন নিয়ে কেঁদে কেঁদে সারা হল ইকো। ছেড়ে দিল অন্নজল। পৃথিবীর আলো আর তার চোখে সইত না। গহন অরণ্যের মাঝে একটা ওক গাছের গভীর গোপন কোটরে ঠাঁই নিল আবার। দিনের পর দিন অনাহারে শরীরের লাবণ্য ঝরে পড়ল। শুকিয়ে যেতে থাকল শরীর। শীর্ণকায়া ইকো দিনে দিনে কায়া থেকে ছায়াতে রূপান্তরিত হল। তারপর একদিন ছায়াটুকুও হারিয়ে গেল ইকোর। বেঁচে রইল শুধু কণ্ঠস্বর-সুরটুকু।

সেই থেকে ইকোর অপরূপ দেহলাবণ্য মিলিয়ে গেল বাতাসে। কায়া থেকে ছায়া, ছায়া থেকে সুর। শতাব্দীর বেড়াজাল পার হয়ে বিদেহী সুরটুকু আজও রয়ে গেছে। আজও আমরা ইকোর কণ্ঠ পাই, স্পর্শ পাই না। অধরা ইকো তেমনিই রয়ে গেছে সুরের মাঝে। অভিমান তার ভাঙেনি। কে জানে কবে কোন নার্সিসাস তাকে আলিঙ্গন করবে।


নিজের প্রতি ভালোবাসা: নার্সিসাসের পরিণতি

আর নার্সিসাস। এগিয়ে চলল ইকোর ভালোবাসা পায়ে মাড়িয়ে। যে ভালোবাসা সে ইকোকে দিল না, সেই ভালোবাসাই তাকে রিক্ত, নিঃস্ব, কাঙাল করে রেখে গেল চিরকালের মতো। খেয়ালী, নির্বোধ, নার্সিসাস অধরা রূপের পিছু পিছু ছুটে চলল-সে ছোটার শেষ নেই।

সে এক করুণ কাহিনী। ইকোকে প্রত্যাখ্যান করার পর নার্সিসাস দ্রুতবেগে চলতে শুরু করল বনের পথে। মাথার উপর মধ্যাহ্নের সূর্য। খরতাপে এবং পথশ্রমে অবসন্ন হয়ে পড়ল নার্সিসাসের শরীর। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি কাঠ। বিশ্রাম আর পানীয়ের আশায় নার্সিসাস উপযুক্ত জায়গার সন্ধানে ঘুরতে লাগল। কিছুক্ষণ এমনিভাবে ঘুরতে ঘুরতে নার্সিসাস বনের মধ্যে একটা শান্ত সরোবর দেখতে পেল। বুক ভরা তৃষ্ণা নিয়ে নার্সিসাস ছুটে গেল সেই সরোবরের তীরে। স্ফটিক স্বচ্ছ সরোবরের জল দেখে নার্সিসাসের তৃষ্ণা আরও বেড়ে গেল। জলের কাছে নেমে এল নার্সিসাস। নিচু হয়ে অঞ্জলি ভরে জল তুলে আনতে গেল। কিন্তু পারলো না নার্সিসাস। হঠাৎ যেন স্তব্ধ হয়ে গেল সে। কোথায় গেল তার তৃষ্ণা? কোথায় গেল ক্লান্তি?

যত ক্লান্তি! মুগ্ধ পলকহীন নয়নে স্বচ্ছ জলের দিকে তাকিয়ে বসে থাকল সে! 

সরোবরের স্বচ্ছ জলে নিজের প্রতিমূর্তি নার্সিসাসকে মুগ্ধ করল। জলের বুকে প্রতিবিম্বিত মূর্তিটাকে ভালোবেসে ফেলল সে। এত রূপ সে জীবনে দেখেনি। নার্সিসাস আপনমনে তার প্রতিচ্ছবির সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। ছায়ামূর্তিও মুখ নেড়ে চলল সমানে। নার্সিসাস যত সেই মূর্তির কাছে এল, সেও এগিয়ে এল নার্সিসাসের কাছে। নার্সিসাস আরও কাছে যেতে চাইল। আরও স্পর্শ করবার জন্য হাত বাড়াল। কিন্তু স্পর্শ করামাত্র খান্ খান্ হয়ে জলের বুকে ছড়িয়ে পড়ল সেই প্রতিমূর্তি। হতবুদ্ধি নার্সিসাস অমনি লাফিয়ে উঠল। ক্ষোভে মাথার চুল ছিঁড়তে লাগল। আস্তে আস্তে সরোবরের জল আবার শান্ত হয়ে এল। জলের বুকে ভেসে উঠল সেই প্রতিচ্ছবি। মুখে মিটিমিটি হাসি। নার্সিসাস ভাবল, সে স্পর্শ করেছে, সেই অভিমানেই বুঝি খান্ খান্ হয়ে গুড়িয়ে যায় তার প্রিয়সাথী। নার্সিসাস হাত নাড়িয়ে কথা দেয় সে আর তাকে স্পর্শ করবে না। সেও হাত নাড়িয়ে প্রতিশ্রুতি দেয় সে আর খান্ খান্ ভেঙে যাবে না। আশ্বস্ত হয়ে নার্সিসাস তীরে বসে শুধু চেয়ে থাকে অপলক। পাহারা দেয় যেন পালিয়ে না যায়। চোখের করুণ মিনতি ভাষা পায় না। যেন বলতে চায়- দেখো আমি কথা রেখেছি। স্পর্শ করিনি তোমায়। তুমি যেন আমায় ফেলে কোথাও যেও না। আবার কখনো বা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার মুখ। আর সে তাকে কখনও হারায় নি!


নার্সিসাস: আত্মপ্রেমের করুণ পরিণতি

দিনের পর দিন সবকিছু ভুলে জলের বুকে নিজের প্রতিচ্ছবির মুখোমুখি বসে থাকল নার্সিসাস। জানল না, সে যাকে ভালোবেসেছে, যার দেহসৌষ্ঠব দেখে মুগ্ধ হয়েছে, যাকে আপন করে হৃদয়ে স্থান দিতে চেয়েছে-সে তো সে নিজেই। তারই শরীরের ছায়া। শুধুই ছায়া।

দেখতে দেখতে অনাহারে শরীর শুকিয়ে গেল। রোদে পুড়ে চামড়া কালো হল। মুখের রক্তিমাভা গেল মিলিয়ে। প্রতিচ্ছবির শরীরের শুষ্কতা দেখে নার্সিসাস আরও ভেঙে পড়ল। ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এল শরীর। নার্সিসাস বুঝেতে পারল তার জীবনীশক্তি শেষ হয়ে এসেছে। মৃত্যুর আগে সে তার প্রতিচ্ছবির দিকে উজ্জ্বল দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে বলল-প্রিয় সাথী। তোমায় ভালোবেসে আমি আমি নিঃস্ব, রিক্ত, এবং মুক্ত হলাম। আমাকে বিদায় দাও বন্ধু। বিদায়। বিদায়। বিদায়। নার্সিসাস ঢলে পড়ল সরোবরের কোলে। জলের বুকে মুখ ডুবিতে প্রথম তার প্রিয়সাথীকে শেষবারের মতো চুম্বন করল।


নার্সিসাস ফুল: এক নতুন রূপে জীবন

হতভাগিনী ইকো নার্সিসাসের গলার স্বরে আকাশে-বাতাসে, বনে বনান্তরে প্রতিধ্বনি তুলল-বিদায়। বিদায়। সেই চরম বিদায়ের ক্ষণে বনের পাখী, ফুল পাতা, গাছ লতা, পাহাড় নদী, সবাই একসুরে বিদায় জানাল নার্সিসাসকে। সূর্যদেবের প্রখর দৃষ্টি চোখের জলে ঝাপসা হয়ে এল। সমস্ত পৃথিবী যেন ডুকরে কেঁদে উঠল। জলপরী আর বনপরীর দল ফুলে ফুলে ঢেকে দিল নার্সিসাসের শরীর। সবার অলক্ষ্যে চোখের জল ফেললেন নদীমাতা লিরিয়োপে। এতদিনে তিনি দৈববাণীর অর্থ বুঝতে পারলেন। নার্সিসাস নিজেকে জেনেই নিজেকে হারাল।

পরীরা ফুলে ঢাকা নার্সিসাসকে রেখে চলে গেল শবযান আনতে। কিন্তু তারা যখন ফিরে এল তখন নার্সিসাসের মৃত শরীর সেখানে আর নেই। অবাক বিস্ময়ে তারা দেখল একগুচ্ছ শ্বেতপাপড়ি নিয়ে একটি মাত্র ফুল ডালপাতা সমেত মৃদু হাওয়ায় দুলছে। স্বচ্ছ জলাধারে পড়েছে তার ছায়া। দুলছে সেও। সবাই সমস্বরে চিৎকার করে উঠল নার্সিসাস। নার্সিসাস। সেই থেকে জন্ম নিল Narcissus ফুল। জলের ধারে আপন ছায়া বুকে নিয়ে ফুটে থাকা নার্সিসাসকে আর চিনতে ভুল হয় কি?

নার্সিসাস: যে যুবক নিজের প্রতিচ্ছবির প্রেমে পড়ে প্রাণ হারায়!

ইকো ও নার্সিসাসের কাহিনী আজও প্রাসঙ্গিক। ইকোর প্রতিধ্বনি আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রত্যাখ্যাত প্রেমের নীরব যন্ত্রণা, আর নার্সিসাসের মৃত্যু শেখায়..... অতিরিক্ত আত্মপ্রেম একসময় আত্মবিনাশ ডেকে আনে। প্রকৃতির বুকে ফুটে থাকা নার্সিসাস ফুল সেই করুণ পরিণতিরই জীবন্ত প্রতীক। পুরাণের এই কাহিনী তাই শুধু ইতিহাসের পাতায় নয়, আমাদের হৃদয়ের গভীরেও বেঁচে থাকে এক সতর্কবার্তা হিসেবে, এক অনন্ত প্রেমকাহিনী হিসেবে।


📚 তথ্যসূত্রঃ

  1. Echo (mythology) – Wikipedia
  2. Narcissus (mythology) – Wikipedia
  3. Hera – Greek Goddess of Marriage – Wikipedia
  4. Zeus – King of the Olympian Gods – Wikipedia
  5. Aphrodite – Goddess of Love – Wikipedia
  6. Liriope (nymph) – Wikipedia
  7. Narcissus (plant) – Origin of the Flower Myth – Wikipedia
  8. Greek Mythology – Encyclopedia Britannica

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
Post a Comment (0)
To Top