মহর্ষি বাল্মীকির জীবনী

3

মহর্ষি বাল্মীকির জীবনী 

প্রাচীনকালে চ্যবন মুনির পুত্র রত্নাকর ছিল এক দুর্ধর্ষ ডাকাত । সে লোহার গদা নিয়ে বনের মধ্যে লুকিয়ে থাকতো । পথিক দেখলেই তাকে হত্যা করে সর্বস্ব কেড়ে নিতো । এইভাবে অনেক দিন ধরে বহু পথিককে সে হত্যা করেছে । 

মহর্ষি বাল্মীকির জীবনী

একদিন রত্নাকরের খুব মন খারাপ । সকাল থেকে সে বসে আছে অথচ কোন পথিকের দেখা নেই । হঠাৎ সে দেখল, বনপথ ধরে দুজন সন্ন্যাসী আসছেন । রত্নাকর ঠিক করলো এদের হত্যা করে সর্বস্ব হরণ করবে । সন্ন্যাসীরা কাছে আসতেই সে গদা তুলে দুজনকে হত্যা করতে ধেয়ে গেল । বলা হয়নি, সন্ন্যাসী দুজন হলেন প্রভু ব্রহ্মা আর দেবর্ষি নারদ । ব্রহ্মার মায়ার প্রভাবে রত্নাকরের ডান হাত অচল হয়ে গেল । বহু চেষ্টা করেও সে আর হাত নাড়াতে পারল না । তখন ব্রহ্মাজী হাসতে হাসতে তাকে বললেন, " হে দস্যু, তুমি আমাদের তো মারতে এসেছ । মানুষ মারলে যে পাপ হয় তা কি তোমার জানা নেই ? তুমি তো দিনের পর দিন এই পাপ কাজ করে চলেছ, তোমার এ পাপের ভাগী কি কেউ আছে ? "

রত্নাকর বললেন, " পাপ-পূণ্য আমি কিছুই চিন্তা করিনি । আমি মানুষ মেরে যে টাকা পাই তাই দিয়ে সংসার চালাই । সংসারে রয়েছে আমার মা, বাবা ও স্ত্রী । যদি মানুষ মেরে পাপ করে থাকি তাহলে, তবে আমরা চার জনই পাপের ভাগী হবো । " একথা শুনে ব্রহ্মা হেসে বললেন, " তোমার পাপের ভাগ নিতে এই পৃথিবীতে কেউ নেই । যদি আমার কথা বিশ্বাস না হয়, তবে, যাও তোমার মা, বাবা এবং স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে এসো, আমরা এখানে অপেক্ষা করছি । "


"বেশ তো সন্ন্যাসী । আমি গৃহে যাই, আর তোমরা এখান থেকে পালাও । সে হবার নয় । যাওয়ার আগে তোমাদের এই গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে যাচ্ছি । " এই বলে সন্ন্যাসী দুজনকে বেঁধে রেখে রত্নাকর বাড়ি গেল । 

প্রথমেই পিতার নিকট গিয়ে রত্নাকর বলল, "পিতাশ্রী, দস্যুবৃত্তি করি, মানুষ হত্যা করে টাকা পয়সা সংগ্রহ করে সংসার চালাই, এতে নাকি আমার পাপ হয় ? তাই যদি হয়, তবে আপনি কি আমার পাপের ভাগী হবেন না ? "

বৃদ্ধ পিতা বললেন, " যখন তুমি শিশু ও অসহাত ছিলে, তখন আমি তোমাকে পালন করেছি । সময়ের পরিবর্তনে আজ তুমি সবল যুবক, আর আমি দুর্বল অসহায় বৃদ্ধ । এখন তুমিই আমাকে পালন করবে-- এই তো সমাজের বিধান । তুমি যেমন করে পার, আমাকে পালন করবে । এ কাজের জন্য তোমাকে তো পাপ করতে বলা হয়নি। তোমার পাপের ভাগ আমি নিতে যাব কেন ? "

পিতার কথা শুনে রত্নাকর চমকে উঠে । চিন্তাকুল মনে সে মায়ের নিকট গিয়ে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে । উত্তরে মা বললেন, " তোমাকে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারন করেছি । গর্ভধারিণীর এ ঋণ কোন সন্তানই শোধ করতে পারে না । তবে আমি তোমার পাপের ভাগ নিতে যাবো কেন ? "

অবশেষে স্ত্রীকেও সে জিজ্ঞেস করলো, " তোমার ভরণ পোষণের জন্য আমি যে পাপ করেছি, তুমি সে পাপের ভাগী হবে কি ? "


উত্তরে স্ত্রী বলল, " দেখুন, আমি আপনার সহধর্মিণী । বিয়ের সময় মন্ত্রপাঠ করে প্রতিজ্ঞা করেছেন যে, আপনি আমাকে পালন করবেন । তাই আমাকে পালন করতে গিয়ে আপনি যদি পাপ করে থাকেন, সে পাপ আমাকে স্পর্শ করবে না । তবে আপনার পূণ্যের অর্ধেক অবশ্যই আমি পাব।"

পিতা, মাতা ও স্ত্রীর এ হেনু কথা শুনে রত্নাকর একেবারে স্তম্ভিত । সে এতদিন ধরে কি করেছে ? যাদের ভরণ পোষণের জন্য  দিনের পর দিন নরহত্যা করতেও পিছপা হয়নি, তারা কেউ তো পাপের ভাগ নিতে রাজি নয় । সে এখন কেমন করে তার পাপের সাগর পার হবে ?

রত্নাকর পাপের চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলো । কাঁদতে কাঁদতে সন্ন্যাসীদের বাঁধন খুলে দিয়ে ভগবান ব্রহ্মার পায়ে পড়ে বলল, " হে সন্ন্যাসী, আপনি ঠিকই বলেছেন, তারা কেউই আমার পাপের ভাগ নেবে না । এখন আমি কি করবো ? ঠাকুর দয়া করে বলে দিন, আমি কেমন করে পাপ থেকে মুক্তি পাবো ? "

রত্নাকরের কান্না দেখে ব্রহ্মাজীর মনে করুণার উদয় হয় । তিনি তাকে পুকুর থেকে স্নান করে আসতে বললেন । রত্নাকর স্নান করতে গিয়ে দেখে তার সামনে থেকে জল শুকিয়ে যাচ্ছে । জলের অভাবে তার স্নান হলো না । অবশেষে ব্রহ্মা তার কমন্ডলু থেকে জল ছিটিয়ে দিলেন রত্নাকরের মাথায় । রত্নাকর গঙ্গাজলে সিক্ত হয়ে ব্রহ্মার চরণপ্রান্তে বসে পড়লো । ব্রহ্মা তাকে রাম নামে দীক্ষিত করে বললেন, তোমাকে আর কিছু করতে হবে না, তুমি শুধু রাম নাম জপ কর । জপ করতে করতে দেখবে তোমার সব পাপ দূর হয়ে যাবে । "

রত্নাকর বহু চেষ্টা করেও রাম নাম উচ্চারণ করতে পারল না । ব্রহ্মা বললেন, " পাপে তোমার জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে গেছে । তুমি এক কাজ কর, মরা মরা বলতে থাক, দেখবে তোমার মুখে 'রাম' নাম আসবে । তুমি এখানে কঠোর সাধনা করতে থাক । আমরা দেবলোকে যাচ্ছি । সেখান থেকে ফিরে তোমার সাথে দেখা করবো । " এই বলে দেবর্ষি নারদকে নিয়ে ব্রহ্মা অন্তর্হিত হলেন । 

রত্নাকর ব্রহ্মার নির্দেশ অনুসারে যোগাসনে বসে এক মনে 'মরা' শব্দটি জপ করছে । 


বহুদিন পর আবার ব্রহ্মাজি চলেছেন সেই রত্নাকর দস্যুর বনপথে । তিনি ভুলেই গেছেন রত্নাকরের কথা । চলতে চলতে হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন, কে যেন অবিরাম রাম নাম জপ করে চলেছে । কোথা থেকে আসছে রামের ধ্বনি ? ধারে কাছে কাউকে তিনি দেখতে পেলেন না । তখন তার মনে পরে রত্নাকরের কথা । কিন্তু কোথায় সে ? কিছুক্ষণ ভালোভাবে লক্ষ করে বুঝলেন, তার সামনের বল্মীকের স্তূপ (উঁইয়ের ঢিবি) থেকে অবিরাম রাম নাম ধ্বনিত হচ্ছে । ব্যাপার কি দেখার জন্য ব্রহ্মাজি দেবরাজ ইন্দ্রকে স্মরণ করলেন । 

ব্রহ্মার নির্দেশমতো ইন্দ্র বল্মীকের স্তূপের উপর অবিরল ধারায় জল বর্ষণ করতে লাগলেন । সাত দিন বৃষ্টি বর্ষণের পর দেখা গেল বল্মীকের স্তূপ আর নেই । সেখানে রয়েছে এক মানুষের কঙ্কাল । সে কঙ্কাল হতেই 'রাম' নাম ধ্বনিত হচ্ছে । ব্রহ্মাজির ইচ্ছায় কঙ্কালের গায়ে রক্ত-মাংস যুক্ত হলো । ব্রহ্মা দেখলেন, এই সেই রত্নাকর । তখন ব্রহ্মা বললেন, "হে রত্নাকর রাম নামে তোমার সমস্ত পাপ ধুয়ে মুছে গেছে । এখন তুমি নিষ্পাপ । তুমি যখন 'রাম' নামে বিভোর ছিলে তখন তোমার গা ঘিরে সৃষ্টি হয়েছিল বল্মীকের স্তূপ । এজন্য আজ থেকে তোমার নাম হলো বাল্মীকি । 

বাল্মীকি মুণি যে রামায়ণ রচনা করেছিলেন সেটা আপনারা সবাই জানেন ।

কিন্তু এটা জানেন কি এই বাল্মীকি মুনিই প্রথম শ্লোক রচনা করেন !

যদি সে বিষয়ে বিশদ জানতে চান তাহলে আমাকে অবশ্যই কমেন্টে জানান । 

নমস্কার ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
To Top