একাদশী কি এবং কেন পালন করা হয় ?

0
একাদশী কি এবং কেন পালন করা হয় ?

Table Of Content (toc)

একাদশী কি এবং কেন করা হয় ?

একাদশী কি ?

একসময় ঋষি জৈমিনি তাঁর গুরুদেব মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেবকে জিজ্ঞাসা করলেন,

হে গুরুদেব! একাদশী কি ? একাদশীতে কেন উপবাস করতে হয় ? একাদশী ব্রত করলে কি লাভ ? একাদশী ব্রত না করলে কি ক্ষতি ? এ সব বিষয়ে আপনি দয়া করে বলুন ।

মহর্ষি ব্যাসদেব তখন বলতে লাগলেন-

সৃষ্টির প্রারম্ভে পরমেশ্বর ভগবান এই জড় সংসারে স্হাবর জঙ্গম সৃষ্টি করলেন । মর্ত্যলোকবাসী মানূষদের শাসনের জন্য একটি পাপপুরুষ নির্মাণ করলেন । সেই পাপপুরুষের অঙ্গণ্ডলি বিভিন্ন পাপ দিয়ে নির্মিত হল ।

পাপপুরুষের মাথাটি ব্রহ্মহত্যা পাপ দিয়ে, চক্ষুদুটি মদ্যপান, মুখ স্বর্ণ অপহরণ, দুই কর্ণ-গুরুপত্নী গমন, দুই নাসিকা-স্ত্রীহত্যা, দুই বাছ-গোহত্যা পাপ, গ্রীবা-ধন অপহরণ, গলদেশ-ভ্রুণহত্যা, বক্ষ-পরস্ত্রী-গমন, উদর- আত্মীয়স্বজন বধ, নাভি-;শরণাগত বধ, কোমর-আত্মশ্লাঘা, দুই ঊরু-ণ্ডরুনিন্দা, শিশ্ন-কন্যা বিক্রি, মলদ্বার-ণ্ডপ্তকথা প্রকাশ পাপ, দুই পা-পিতৃহত্যা, শরীরের রোম-সমস্ত উপপাতক ।

এভাবে বিভিন্ন সমস্ত পাপ দ্বারা ভয়ঙ্কর পাপপুরুষ নির্মিত হল । পাপপুরুষের ভয়ঙ্কর রূপ দর্শন করে ভগবান শ্রীবিষ্ণু মর্ত্যের মানব জাতির দু্খঃ মোচন করবার কথা চিন্তা করতে লাগলেন । একদিন গরুড় পিঠে চড়ে ভগবান চললেন যমরাজের, মন্দিরে । ভগবানকে যমরাজ উপযুক্ত স্বর্ণ সিংহাসনে বসিয়ে পাদ্য অর্ঘ্য ইত্যাদি দিয়ে যথাবিধি তাঁর পূজা করলেন ।

যমরাজের সঙ্গে কথোপকথনকালে ভগবান শুনতে পেলেন দক্ষিণ দিক থেকে অসংখ্য জীবের আর্তক্রন্দন ধ্বনি ।

প্রশ্ন করলেন-এ আর্তক্রন্দন কেন? যমরাজ বললেন, হে প্রভু, মর্ত্যের ,পাপী মানুষেরা নিজ কর্মদোষে নরকযন্ত্রনা ভোগ করছে । সেই যাতনার আর্ত চীৎকার শোনা যাচ্ছে । যন্ত্রণাকাতর পাপাচারী জীবদের দর্শন করে করুণাময় ভগবান চিন্তা করলেন- আমিই সমস্ত প্রজা সৃষ্টি করেছি, আমার সামনেই ওরা কর্ম দোষে দুষ্ট হয়ে নরক যান্ত্রণা ভোগ করছে, এখন আমিই এদের সদগতির ব্যাবস্হা করব ।

ভগবান শ্রীহরি সেই পাপাচারীদের সামনে একাদশী তিথি রূপে এক দেবীমূর্তিতে প্রকাশিত হলেন । সেই পাপীদেরকে একাদশী ব্রত আচরণ করালেন । একাদশী ব্রতের ফলে তারা সর্বপাপ মুক্ত হয়ে তৎক্ষণাৎ বৈকুন্ঠ ধামে গমন করল । শ্রীব্যাসদেব বললেন, হে জৈমিনি ! শ্রীহরির প্রকাশ এই একাদশী সমস্ত সুকর্মের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং সমস্ত ব্রতের মধ্যে উত্তম ব্রত ।

কিছুদিন পরে ভগবানের সৃষ্ট পাপ পুরুষ এসে শ্রীহরির কাছে করজোড়ে কাতর প্রার্থণা জানাতে লাগল-হে ভগবান ! আমি আপনার প্রজা। আমাকে যারা আশ্রয় করে থাকে,তাদের কর্ম অনূযায়ী তাদের দুঃখ দান করাই আমার কাজ ছিল । কিন্তু সম্প্রতি একাদশীর প্রভাবে আমি কিছুই করতে পারছি না, বরং ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছি । কেননা একাদশী ব্রতের ফলে প্রায় সব পাপাচারীরা বৈকূণ্ঠের বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছে ।

হে ভগবান, এখন আমার কি হবে ? আমি কাকে আশ্রয় করে থাকব ? সবাই যদি বৈকূণ্ঠে চলে যায়, তবে এই মর্ত্য জগতের কি হবে ? আপনি বা কার সঙ্গে এই মর্ত্যে ক্রীড়া করবেন ? পাপপুরুষ প্রার্থনা করতে লাগল- হে ভগবান, যদি আপনার এই সৃষ্ট বিশ্বে ক্রীড়া করবার ইচ্ছা থাকে তবে, আমার দুঃখ দূর করুন । একাদশী ভয় থেকে আমাকে রক্ষা করুন ।

হে কৈটভনাশন, আমি একমাত্র একাদশীর ভয়ে ভীত হয়ে পলায়ন করছি । মানুষ, পশুপাখী, কীট-পতঙ্গ, জলত-স্হল, বনপ্রান্তর, পর্বত-সমূদ্র, বৃক্ষ, নদী, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল সর্বত্রই আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্ত একাদশীর প্রভাবে কোথাও নির্ভয় স্থান পাচ্ছি না দেখে আজ আপনার শরণাপন্ন হয়েছি ।

হে ভগবান, এখন দেখছি, আপনার সৃষ্ট অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে একাদশীই প্রাধান্য লাভ করেছে, সেইজন্য আমি কোথাও আশ্রয় পেতে পারছি না । আপনি কৃপা করে আমাকে একটি নির্ভয় স্হান প্রদান করুন ।

পাপপুরুষের প্রার্থনা শুনে ভগবান শ্রীহরি বলতে লাগলেন-হে -পাপপুরুষ ! তুমি দুঃখ করো না । যখন একাদশী এই ত্রিভুবনকে পবিত্র করতে বির্ভুত হবে, তখন তুমি অন্ন ও রবিশস্য মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করবে, তা হলে আমার মূর্তি একাদশী তোমাকে বধ করতে পারবে না ।

এখানেঃ একাদশীর পারণ মন্ত্র


একাদশী কেন পালন করা হয় ?

একাদশী ব্রতের ফল

১. সকল পুরাণে মুনিদিগের এই নিশ্চিত মত যে, একাদশীতে উপবাস করলে সকল পাপ হতে মুক্ত হবে এতে কোন সন্দেহ নেই । (ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ)

২. শ্রীযমরাজ ব্রাহ্মনকে বলেছেন, হে ব্রাহ্মন ! যাদের পুত্র ও পৌত্র একাদশী ব্রত করে আমি শাসন কর্তা যম হয়েও বিশেষরূপে তাদের নিকট ভীত হই । যারা একাদশী ব্রত পরায়ন সেই মহাত্মারা বল পূর্বক স্বীয় শত পুরুষ উদ্ধার করেন । (পদ্মপুরাণ)

৩. একাদশীতে যে উপবাস, ইহাই সার, ইহাই তত্ত¡, ইহাই সত্য, ইহাই ব্রত, ইহাই সম্যক প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ । (ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ)

৪. যে মানুষ একাদশীর দিন শস্যদানা গ্রহণ করে সে তার পিতা, মাতা, ভাই এবং গুরু হত্যাকারী এবং সে যদি বৈকুন্ঠলোকে উন্নীত হয় তবুও তার অধঃপতন হয় ।

একাদশীর দিন বিষ্ণুর জন্য সব কিছু রন্ধন করা হয় এমনকি অন্ন এবং ডাল ও কিন্তু শাস্ত্রের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, বৈষ্ণবদের সেই বিষ্ণুর প্রসাদ পরের দিন গ্রহণ করার জন্য রেখে দেওয়া যেতে পারে ।

একাদশীর দিন কোন রকম শস্যদানা এমনকি অন্ন তা যদি বিষ্ণুর প্রসাদও হয় তবুও তা গ্রহণ করতে কঠোর ভাবে নিষেধ করা হয়েছে । বিধবা না হলেও শাস্ত্র অনুসারে একাদশী ব্রত পালন করার প্রথা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রবর্তন করেছিলেন । (শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত আদিলীলা ১৫/৮-১০) । অনেকের ধারনা শ্রীপুরীধামে শ্রীজগন্নাথদেবের প্রসাদ ভক্ষন দোষাবহ নহে। এই ধারনার বশবর্তী হইয়া পুরীতে অনেকেই নিঃসঙ্কোচে অন্ন গ্রহণ করেন, ইহা সম্পূর্ণ শাস্ত্র বিরুদ্ধ বিচার ।

বিধবা নারী এবং মতিগণ (তেজস্বী) যদি একাদশী ব্রত না করে তাহলে প্রলয়কাল পর্যন্ত তাদের অন্ধকারময় নরকে পঁচে মরতে থাকে । (শারদীয় পুরাণ)

হে রাজন ! যতদিন আয়ু থাকবে ততদিন একাদশী উপবাস থাকবে । (অগ্নিপুরাণ)

বিধবা রমণী একাদশীতে আহার করলে,তার সর্বপ্রকার সুকৃতি নষ্ট হয় এবং দিনদিন তার ভ্রণহত্যা পাপের অপরাধ হয় । (কাত্যায়ন সংহিতা)

যিনি একাদশী ব্রত পরিত্যাগ করে অন্য ব্রতের উপসনা করেন, তার হাতের মহামূল্যবান রত্নপরিত্যাগ করে লোহা যাচনা করা হয় । (তত্ত্বসাগর)

দেবাদিদেব শিব দূর্গা দেবীকে বলেছেন হে মহাদেবী যারা হরিবাসরে (একাদশীতে) ভোজন করে যমদূতগণ যমালয়ে নিয়ে তাদের অগ্নিবর্ন তীক্ষ্ণ লৌহাস্ত্র তাদের মুখে নিক্ষেপ করে । (স্কন্দপুরাণ)

আরো জানুনঃ একাদশীর দিন কি কি খাওয়া যাবে না ?


একাদশী ব্রত পালনের নিয়ম

সামর্থ্য অনুযায়ী দশমী তে একাহার, একাদশী তে নিরাহার, দ্বাদশীতে একাহার । এতে অসমর্থ হলে শুধু একাদশীতে অনাহার ।

যদি এতেও অসমর্থ হয়, একাদশী তে পঞ্চ শস্য বর্জনীয়, ফলমূল ও কিছু সবজি গ্রহনের বিধান আছে ।

যেমন-গোল আলু, মিষ্টি আলু, কুমড়া, চালকুমড়া, বাদাম তেল/সূর্যমুখি তেল/ঘি দিয়ে রান্না করে ভগবানকে উতসর্গ করে আহার করা যেতে পারে। এছাড়া দুধ, কলা, আপেল, আনারস, পেঁপে, পেয়ারা, শসা, নারকেল, মিষ্টি আলু ইত্যাদি ফল আহার করা যাবে ।

একাদশীর পারন সময় পঞ্জিকাতে দেয়া থাকে, ভগবান কে অন্ন নিবেদন করে সেই প্রসাদ নিদিষ্ট সময়ে গ্রহন করতে হবে । নতুবা একাদশীর ফল লাভ হয়না ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top