গ্রিক পুরাণ শুধু দেবতা আর দেবীদের অলৌকিক কাহিনী নয়, এতে লুকিয়ে আছে মানব-জীবনের গভীরতম আবেগ, প্রেম, প্রতারণা ও ধ্বংসের করুণ কাহিনী । সেই পুরাণের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলির একটি হলো প্যারিস ও হেলেনের প্রেম । একটি প্রেম, যা ছিল স্বর্গীয় প্রতিশ্রুতির ফল। কিন্তু তার পরিণতিতে সমগ্র নগরীর পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। দেবীদের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, এবং মানব হৃদয়ের দুর্বলতা মিলেমিশে এখানে রচিত হয়েছে ইতিহাসের অন্যতম মহাকাব্যিক ট্র্যাজেডি, ট্রয় যুদ্ধের সূচনা।
প্যারিস এবং হেলেন
প্যারিসের প্রতিভা ও ট্রয়ে প্রত্যাবর্তন
দেবী অ্যাফ্রোদিতে এর কথামতো ট্রয়ের বীরযোদ্ধা হেকটরের অনুজ 'প্যারিস' নিজেকে মানবসমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইল। ট্রয় রাজ্যে অনুষ্ঠিত একটি অনুষ্ঠানে বড়ো বড়ো যোদ্ধাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করল প্যারিস। একে একে সকল যোদ্ধাই পরাজয় স্বীকার করল প্যারিসের নিপুণ কৌশল এবং সাহসের কাছে। প্রায়াম এর অন্যান্য পুত্ররাও পরাজয় স্বীকার করে নিতে বাধ্য হল। কিন্তু সামান্য একজন মেষপালকের কাছে হেরে গিয়ে তারা গোপনে প্যারিসের জীবন নাশের ফন্দি আঁটতে শুরু করল। কিন্তু যে মেষপালক একদিন শিশু প্যারিসকে ট্রয়ের রাজা প্রায়ামের কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিল রাজবাড়ি ছেড়ে বহুদূরে নির্বাসিত জীবনে, সে জানতে পারল প্রায়াম-পুত্রদের ফন্দির কথা। সরাসরি রাজার কাছে এসে জানাল যে এই অনুষ্ঠানের একমাত্র অপরাজেয় বীর যুবক রাজা প্রায়ামেরই নির্বাসিত শিশুপুত্র প্যারিস।
মেষপালকের কথা শুনে রাজা প্রায়াম তো আনন্দে আটখানা। তার পরিত্যক্ত শিশুপুত্রই আজকের সেরা বীরপুরুষ! সঙ্গে সঙ্গে যোগ্য সম্মান দিয়ে প্যারিসকে ফিরিয়ে নিল ট্রয়রাজ প্রায়াম এবং রাজমহিষী হেকাবে।
ভবিষ্যদ্বাণী ও প্রায়ামের সিদ্ধান্ত
নির্বাসিত পুত্রকে গৌরবজনকভাবে ফিরে পাবার পর আবার উৎসব শুরু হল ট্রয়ে। বীর পুত্রের জন্য প্রায়াম গর্বিত। গর্বিনী রাণী হেকাবে। এমন সময় অ্যাপোলোর মন্দিরের পুরোহিতরা এলেন রাজদরবারে। ঘোষণা করলেন মর্মান্তিক এক ভবিষ্যদ্বাণী—প্যারিসকে হত্যা করো, নতুবা ট্রয়ের ধংস অনিবার্য। এবার প্রায়াম আর বিচলিত হল না। সদর্পে জবাব দিল প্রায়াম, আমার বীরপুত্র প্যারিসের জীবনের বিনিময়ে ট্রয়ের ধ্বংস তুচ্ছ। সমগ্র জাতির বিনিময়ে আমার একটিমাত্র পুত্রের জীবন রক্ষা করা কর্তব্য। ট্রয়ের পতন হোক, প্যারিস জীবিত থাকুক। নিজের আসনে প্রতিষ্ঠিত হবার পর প্যারিস পিতা প্রায়ামকে জানাল যে দেবী অ্যাফ্রোদিতের নির্দেশে তাকে স্পার্টা যাত্রা করতে হবে। প্রায়াম যেন তাকে নিঃশঙ্কচিত্তে অনুমতি দান করে। যাত্রার জন্য জাহাজ চাই। চাই কিছু অনুচর যোদ্ধা।
আরো জানুনঃ অ্যাপোলো - সৌন্দর্যের আড়ালে এক মানবিক দেবতার গল্প
সানন্দে অনুমতি দিল প্রায়াম। প্যারিসের জন্য জাহাজ প্রস্তুত। সেরা সেরা কয়েকজন যোদ্ধার মধ্যে সাজ সাজ রব। কিছুদিনের মধ্যেই ট্রয়ের বন্দর ছেড়ে প্যারিসের সুসজ্জিত জাহাজ সাগরের নীল জল কেটে কেটে এগিয়ে চলল স্পার্টার উদ্দেশে।
স্পার্টায় প্যারিস ও হেলেনের সাক্ষাৎ
সমুদ্রের বুকে দেবী অ্যাফ্রোদিতে পাঠালেন অনুকূল বাতাস। দেখতে দেখতে প্যারিসের জাহাজ স্পার্টার বন্দরে এসে পৌঁছল। ট্রয়ের বীর রাজপুত্র প্যারিসকে সাদর অভ্যর্থনা জানাল হেলেনের স্বামী মেনেলাওস। প্যারিসের আগমনে স্পার্টার রাজপ্রাসাদে নদিন ব্যাপী এক বিরাট উৎসব শুরু হল। স্বয়ং হেলেন এগিয়ে এসে অতিথির সেবার দায়িত্ব তুলে নিল নিজের হাতে। পানীয়ের পাত্রে পানীয় পরিবেশন করল হেলেন। প্যারিসের কাছে এল বারবার। হেলেনের রূপে প্যারিস মুগ্ধ। দুজনেই দুজনের চোখের ভাষা পড়ে ফেলল। একে অপরের চোখে চেয়ে থাকতে থাকতে অচেনা কোন রূপের জগতে অবলীলায় পাড়ি দিল। স্বপ্নাবিষ্ট প্যারিস ফিস্ফিসিয়ে বলে উঠল—সুন্দরী হেলেন, আমি তোমায় ভালোবাসি। চিরকাল ভালোবাসব।
দেবীদের দ্বন্দ্ব ও হেলেনের অপহরণ
এমন সময়ে বিশেষ কাজে মেনেলাওস ক্রীট অভিমুখে যাত্রা করল। মেনেলাওসের অনুপস্থিতিতে দেবী অ্যাফ্রোদিতে হেলেনকে তুলে দিলেন প্যারিসের হাতে। কিন্তু এ এক ভিন্ন হেলেন। দেবী অ্যাফ্রোদিতের হাতে গড়া নকল হেলেন। স্পার্টার রাণী মেনেলাওসের স্ত্রী সুন্দরী হেলেন ততক্ষণে মিশর দেশে প্রোতেয়ুস এর রাজপ্রাসাদে নিরাপদে অবস্থান করছে। স্বর্গের দেবীদের মধ্যে ক্ষমতার রেষারেষি, টানাপোড়েন।
এ সবই সেই 'সুন্দরীশ্রেষ্ঠা' প্রতিযোগিতা র ফলাফল। অংশগ্রহণকারিণী তিন দেবীর কারসাজি। হেরা-এথেনা-অ্যাফ্রোদিতি। প্যারিসের বিচারে অ্যাফ্রোদিতে স্বর্গের শ্রেষ্ঠা সুন্দরীর পুরস্কার জিতে নিয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন হেলেনকে তিনি যে কোনো উপায়ে প্যারিসের কাছে এনে দেবেন। এদিকে হেরা এবং এথেনা সঙ্কল্প করলেন অ্যাফ্রোদিতের সমস্ত পরিকল্পনা বাঞ্চাল করে জব্দ করবেন প্যারিসকে।
হেরা ও জিয়ুসের হস্তক্ষেপ
তাই যখন দেখলেন অ্যাফ্রোদিতের পরিকল্পনা সফল হতে চলেছে, স্বর্গের রাণী হেরা গিয়ে কেঁদে পড়লেন জিয়ুস এর কাছে। আবেদন জানালেন, সুন্দরী হেলেনকে অ্যাফ্রোদিতের কবল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসতে।
হেরা স্বর্গের রাণী। জিয়ুসের স্ত্রী। তাই জিয়ুস দেবদূত হার্মেস কে পাঠালেন স্পার্টায় হেলেনের সন্ধানে। কর্তব্যপরায়ণ হার্মেস স্পার্টার রাজপ্রাসাদ থেকে সবার অলক্ষ্যে হেলেনকে তুলে নিয়ে এলেন মেঘের রাজ্যে। তারপর জিয়ুসের নির্দেশে তাকে নামিয়ে নিয়ে এলেন মিশরদেশে দয়ালু এবং ধার্মিক রাজা প্রোতেয়ুসের রাজপ্রাসাদে। অসহায় হেলেন একাকিনী পড়ে রইল স্পার্টা ছেড়ে সুদূর নীলনদের দেশে।
নকল হেলেনের সঙ্গে ট্রয়ে প্রত্যাবর্তন
এদিকে অ্যাফ্রোদিতি যখন দেখলেন তাঁর সমস্ত পরিকল্পনা হেরার কূটচালে বাঞ্চাল হয়ে যায় যায়, প্যারিসের কাছে তাঁর প্রতিজ্ঞাভঙ্গ হতে চলেছে, দিশাহারা অ্যাফ্রোদিতে মেঘপুঞ্জ দিয়ে তৈরি করলেন হেলেনের এক নকল প্রতিমূর্তি। এবং প্যারিস অ্যাফ্রোদিতি নির্মিত হেলেনের সেই নকল প্রতিমূর্তি সঙ্গে নিয়ে রওনা দিল ট্রয়ের পথে। ট্রয়ে ফিরে প্যারিস আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহ করল হেলেনকে। রাজা প্রায়াম বিনা দ্বিধায় বরণ করে নিলেন প্যারিস এবং পুত্রবধূ হেলেনকে। ওদিকে মন্দিরে মন্দিরে দৈববাণী ঘোষিত হল ট্রয়ের ধ্বংস সন্নিকট। প্রায়াম-পুত্র প্যারিসই এই ধ্বংসের অনিবার্য কারণ।
সব কিছুর বাইরে অথচ সবকিছুকে জড়িয়ে ধার্মিক রাজা প্রোতেয়ুসের প্রাসাদে এক নির্বাসিত জীবন যাপন করতে লাগল স্পার্টার রাজমহিষী সুন্দরী হেলেন।
প্যারিস ও হেলেনের প্রেম ছিল আকস্মিক, কিন্তু তার ছায়া গিয়েছিল সমগ্র মানবজাতির ভাগ্যে। দেবীদের ঈর্ষা, প্যারিসের বেপরোয়া সিদ্ধান্ত, এবং প্রায়ামের একগুঁয়েমি মিলেমিশে ট্রয়ের পতন অবধারিত হয়ে দাঁড়াল।
হেলেন মিশরে নির্বাসিত রইলেন, অথচ ট্রয়ের মানুষ নকল হেলেনকে বরণ করল নিজেদের ধ্বংসের দূত হিসেবে। এখানে প্রেম পরিণত হলো অভিশাপে, আর দেবীদের প্রতিযোগিতা রূপ নিল এক শহরের সর্বনাশের কারণ হিসেবে।
গ্রিক পুরাণের এই কাহিনী যেন আমাদের সতর্ক করে দেয়, অহংকার, লোভ আর অন্ধ প্রেম একসঙ্গে যখন মানবজীবনকে গ্রাস করে, তখন ধ্বংস ছাড়া আর কোনো পরিণতি হয় না। ট্রয়ের পতন তাই কেবল এক পুরাণ নয়, মানব-সভ্যতার জন্য এক চিরন্তন শিক্ষা।
📚 তথ্যসূত্র
- Greek Mythology – The Judgment of Paris – থিওই প্রোজেক্টে প্যারিস, হেলেন এবং ট্রয় যুদ্ধের কাহিনী।
- Encyclopaedia Britannica – Helen of Troy – হেলেন অফ ট্রয় সম্পর্কে বিস্তৃত তথ্য।
- World History Encyclopedia – Paris, Prince of Troy – প্যারিসের জীবনী ও ট্রয়ের পতনে তার ভূমিকা।
- Greek Mythology – The Trojan War – ট্রয় যুদ্ধের মূল কাহিনী ও দেবতাদের ভূমিকা।
- Perseus Digital Library – Homer’s Iliad – মূল গ্রিক মহাকাব্য ইলিয়াড (হোমার), যেখানে ট্রয় যুদ্ধের প্রাথমিক অংশ বর্ণিত।
- History Channel – The Trojan War – ইতিহাসবিদদের দৃষ্টিতে ট্রয় যুদ্ধের আলোচনা।