১৯৪৭ হিন্দু গণহত্যার ইতিহাস - পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ)

0
১৯৪৭ হিন্দু গণহত্যার ইতিহাস - পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ)

পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু গণহত্যার অজানা ইতিহাস

১৯৪৭ সালে দেশভাগের অনেক পূর্বেই পশ্চিম পাকিস্তানে শুরু হয় হিন্দু-শিখ নিধন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান ছিল তখন অপেক্ষাকৃত শান্ত। ঝড়ের পূর্বে যেমন প্রকৃতি। বিশিষ্ট সমাজতন্ত্রী নেতা ও প্রাক্তন সাংসদ অধ্যাপক সমর গুহ সেই অবস্থার সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন: হিন্দু আতঙ্কিত। সর্বগ্রাসী ভীতি তাকে এমন আচ্ছন্ন করেছে যে মুসলমান মাত্রেই তার প্রভু বা হুজুর। সে পরিত্যাগ করেছে তার চিরাচরিত পোশাক-পরিচ্ছদ, অভ্যাস ও রীতি নীতি, গ্রহণ করেছে মুসলিম পোশাক-লুঙ্গি ও পায়জামা। ভারতীয় নেতৃবৃন্দ, এমন কি গান্ধী ও নেতাজীর ছবিও হিন্দুর ঘর থেকে অপসারিত। অ-মুসলমানের ঘরে শোভা পাচ্ছে মিঃ জিন্নার প্রতিকৃতি। পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের নিদর্শন! নিষিদ্ধ হয়েছে "বন্দেমাতরম্" ও অন্যান্য দেশাত্মবোধক সংগীত। ভারতের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে যে কোন রকম সম্পর্ক দেশদ্রোহিতা বলে গণ্য হয়। ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সমঝোতা সংক্রান্ত কোন আলোচনাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শাস্তির মেয়াদ ১০ বছর।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান (অন্তর্বর্তী সরকারে নেহেরুর অর্থমন্ত্রী) বলেনঃ

এই উপমহাদেশের মুসলমানের দীর্ঘদিনের আকাঙক্ষা যে ইসলামের শিক্ষা ও ঐতিহ্য অনুসারে তাদের জীবন বিকশিত হোক। সেই আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের উদ্দেশ্যেই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা। আমরা পাকিস্তানিরা এজন্য বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ বোধ করি না যে আমরা প্রায় সকলেই মুসলমান। আমেরিকা সফরে গিয়ে লিয়াকত আলি বলেন: স্বাধীনতা লাভ করে উদ্দেশ্য সাধনে তাঁরা দৃঢ়সংকল্প। স্বাধীন ভাবে তাঁরা তাঁদের মতামত ব্যক্ত করবেন; উপাসনা করবেন আল্লার এবং অনুশীলন করবেন ইসলামিক জীবনচর্যার। (Pakistan was founded because the Muslims of this sub-continent wanted to build up their lives in accordance with the teachings and traditions of Islam. We, as Pakistanis, are not ashamed of the fact that we are overwhelmingly Muslims...Having achieved independence they (Muslims)are determined to pursue the aims...that they should be free to hold opinions, worship God in freedom and folow the Islamic way of life.)


একই অভিমত ব্যক্ত করেন পূঃ পাকিস্তানের প্রাক্তন গভর্নর ফিরোজ খান নুনঃ

ইসলামিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে তার তাৎপর্য উপলব্ধি করা প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যে প্রথম যে বইখানির আমরা শরণাপন্ন হব তা হল পবিত্র কোরান। (In order to establish an islamic Democracy, it is essential that we should know what it means and for this purpose the first book we should consult should be the holy Quran.)

অধ্যাপক সমর গুহ বলেন:

ইসলামের আদর্শই হল রাষ্ট্রের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ অর্থাৎ ইসলামের আদর্শকে বাস্তবায়িত করার জন্যই পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা। শুধু মুসলমান নয়-সকলের প্রতি তা সমভাবে প্রযোজ্য।


বিষয়টির ব্যাখ্যা করে লিয়াকত আলি বলেন:

মুসলমানের শুধুমাত্র স্বাধীন ধর্মাচরণের জন্য নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করেই রাষ্ট্র তার কর্তব্য শেষ করবে না। কারণ তা হবে পাকিস্তান দাবির আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে অস্বীকার করার শামিল। (The State is not to play the part of neutral observer wherein the Muslims may be merely free to profess and practise their religion, because such an attitude on the part of the state would be the very negation of the ideals which prompted the demand of Pakistan.)'

এর সরল অর্থ মুসলমানের পক্ষ নিয়ে ইসলামের আদর্শ অনুসারে সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার জন্য রাষ্ট্র সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে।

ইসলাম শুধুমাত্র ধর্মীয় "নীতিমালা" নয়। লিয়াকত আলি বলেন:

সমাজ ব্যবস্থা ও সামাজিক ক্রিয়া-কাণ্ডের জন্য ইসলাম নির্দিষ্ট বিধি প্রণয়ন করেছে। জীবনের সর্বক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থাও ইসলামিক অনুশাসনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। (Islam lays down specific directions for social behaviours. It pervades all aspect of our life. It relates to our system of Govt. and to our society with equal validity.)

পাক্-সংবিধান পরিষদের সদস্য ও Jamiat-ul-Ulema-e-Islam-এর সভাপতি মৌলানা সাবির আহমেদ ওসমানির মতে:

ইসলামিক রাষ্ট্রের অর্থ হল যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ইসলামের মহান আদর্শের দ্বারা পরিচালিত হবে। (...Islamic State means a state which is run on the exalted and excellent principles of Islam.)

একথা দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার, পাকিস্তান হল সর্ব অর্থেই মুসলিম জাতির জন্য একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র। ইসলামের আদর্শ তার ভিত্তিস্বরূপ। ইসলামের উদ্দেশ্য সাধনই হবে সে রাষ্ট্রের মুখ্য উদ্দেশ্য। এমন যে রাষ্ট্র সেখানে অ-মুসলমানের স্থান কোথায়? অধ্যাপক সমর গুহের তাই বিস্মিত জিজ্ঞাসা:

কিভাবে সংখ্যালঘুরা রাষ্ট্রের আদর্শকে (তাঁদের নয় বলে) অস্বীকার করতে পারে? স্বৈরাচারী সর্বাত্মক রাষ্ট্রের কথা বাদ দিয়েও বলা যায়, পৃথিবীর কোন রাষ্ট্র কি রাষ্ট্রীয় আদর্শের পাশাপাশি অন্য কোন আদর্শ বা তত্ত্বকে স্বীকার করে নেবে? স্বভাবতই অ-মুসলমানরা স্বেচ্ছায় বা বাধ্য হয়েই ইসলামিক তত্ত্বকেই গ্রহণ করবে... কালক্রমে হয় নিশ্চিহ্ন হওয়া অথবা ইসলাম গ্রহণ করা ব্যতীত অ-মুসলমানদের কোন গত্যন্তর নেই। (How then, the minorities can refuse to accept the Ideology of the State as not their own? Will any state, to speak the least of a totalitarian one, tolerate the existence of a separate ideology side by side with the ideology of the State? Obviously the non-Muslim minorities of Pakistan, whether willingly or per force, are bound to accept Islamic Ideology as their own...the fate of the non-Muslims awaits either elimination from Pakistan or gradual absorption in its body politics.)

ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তানে অ-মুসলমানের কোন বৈধ অধিকার নেই। এমনকি নেই জীবনের নিরাপত্তা। ইসলামের সুনির্দিষ্ট বিধান অনুযায়ী তাঁদের সামনে দুটি পথ খোলা আছে-Either Islam or Death-ইসলাম অথবা মৃত্যু। অথচ আধুনিক রাষ্ট্রদর্শন অনুযায়ী সেও পাকিস্তান রাষ্ট্রের নাগরিক। সমস্যা-সমাধানে "জিম্মি" (zimmie) শব্দটির পুনঃপ্রবর্তন হয়। "ইসলামিক রাষ্ট্রে বসবাসকারী অ-মুসলমানকে বলা হয় "জিম্মি"। "জিজিয়া" কর দিয়ে সে জীবনের সুরক্ষা ও কিছু সুযোগ-সুবিধা লাভ করে। (A "Zimmie", according to Islamic history, is a non-Muslim in an Islamic State, who is entitled to get protection and limited benefit from the state on payment of a certain Zizia tax.)' পাকিস্তানে "জিম্মি" এখন বহুল প্রচারিত। পাকিস্তান মুসলমি লীগ সরকারী ভাবেই হিন্দুর পক্ষে চরম অপমান স্বরূপ "জিম্মি" শব্দটি ব্যবহার করছে।

১৯৪৭ হিন্দু গণহত্যার ইতিহাস - পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ)
পরিবারসহ লিয়াকত আলী খান

"পাকিস্তান-রাষ্ট্র" এই উপমহাদেশের মুসলমানদের জাতীয় আশা-আকাঙক্ষার মূর্ত প্রতীক। তাঁদের স্বপ্নের দেশ পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ইসলামিক রাষ্ট্র ঘোষণা এবং তদনুযায়ী বিধি-ব্যবস্থা প্রণয়ন লোকচক্ষুর অন্তরালে হয়নি। পাক-রাষ্ট্র নেতারা তা করেছেন সগৌরবে, বিশ্ববাসীকে জানিয়ে। এদেশের বিচক্ষণ বিদগ্ধ প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের তা নিশ্চয়ই অবিদিত ছিল না। ধর্ম ও জাতির ভিত্তিতে দেশভাগ করেও তাঁরা লোক বিনিময়ের প্রস্তাব উপহাসের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। অবশ্য তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের সুরক্ষার নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।


আরো জানুনঃ কলকাতার দাঙ্গা ১৯৪৬: প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের রক্তাক্ত ইতিহাস

(ক) কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি-২৫ নভেম্বর '৪৭

যে সকল অ-মুসলমান জীবন ও সম্মান রক্ষার্থে পাকিস্তান হতে ভারতে চলে আসবে-কংগ্রেস তাঁদের সুরক্ষার সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। (The congress is bound to afford full protection to all those non-Muslims from Pakistan who have crossed the border and come over to India, or may do so to save their life and honour.)


(খ) পণ্ডিত নেহেরু-১৫ আগস্ট '৪৭

আমরা আজ সেই সকল ভাই-বোনদের কথাও স্মরণ করছি-রাজনৈতিক সীমানা বিন্যাস যাঁদের আমাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে, এবং দুর্ভাগ্যক্রমে যাঁরা সদ্যলব্ধ স্বাধীনতার আনন্দে অংশ গ্রহণ করতে পারছেন না; তাঁরা আমাদের এবং সকল অবস্থায় তাঁরা আমাদেরই থাকবেন। তাঁদের সুখ-দুঃখের আমরা সম-অংশীদার। (We think also of our brothers and sisters who have been cut off from us by the political boundaries and who unhappily cannot share at present in the freedom that has come, they are of us and will remain of us whatever may happen and we shall be sharers in their good and ill fortune alike.)'


(গ) সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল-১৫ আগস্ট, '৪৭

সীমানার ওপারে আমাদের যে ভাই বোনেরা রয়েছেন, তাঁরা যেন না ভাবেন যে আমরা তাদের ভুলে গেছি অথবা অবহেলা করছি। আমরা সাগ্রহে তাঁদের ভবিষ্যৎ কল্যাণের প্রতি দৃষ্টি রাখছি। এই দৃঢ় আশা ও প্রত্যয় আমাদের আছে যে, অনতিবিলম্বেই মাতৃভূমির প্রতি আনুগত্যে আমরা আবার ঐক্যবদ্ধ হব। (But let not our brethren across the border feel that they are neglected and forgotten. Their welfare will claim our vigilance and we shall follow with abiding interest their future in full hope and confidence that sooner than later we shall be united in common allegience to our country.)


২৬ জুলাই '৪৭ ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর সতর্কবাণীঃ

পূর্ব বঙ্গের হিন্দুদের প্রতি আমাদের যে মহান দায়িত্ব রয়েছে-পঃ বঙ্গের সরকার এবং জনগণকে তা অবশ্যই পালন করতে হবে। তাঁরা যদি তা না করেন তবে তা হবে চরম বিশ্বাসঘাতকতা। (We have a great responsibility towards the Hindus in East Bengal and that must be discharged by the Govt. and people of this province. If they fail to do so, they will be guilty of the grossest betrayal.)'


ডঃ শ্যামাপ্রসাদের আশঙ্কাই সত্য বলে প্রমাণিত হল। পণ্ডিত নেহেরু ও কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতি যে বাক্-বিন্যাসের অন্তরালে এক সুপরিকল্পিত চক্রান্ত-পরবর্তী ইতিহাস তার সাক্ষী।

পশ্চিম পাকিস্তানে হিন্দুমেধ যজ্ঞ (শিখরাও হিন্দু) '৪৭-সালের ফেব্রু-মার্চ শুরু হয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর তা চরম আকার ধারণ করে। এবারে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় তার পুনরাবৃত্তি। বিশিষ্ট লেখক শ্রীদেবজ্যোতি রায়ের রচনা থেকে তা সংক্ষেপে উদ্ধৃত করা হল:

১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলি সংবিধান পরিষদে একটি প্রস্তাব আনেন যাতে বলা হয়: ইসলামে বর্ণিত গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সাম্য, সহিষ্ণুতা ও সামাজিক ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সংবিধান রচিত হবে। আবহাওয়া ধীরে-ধীরে উত্তপ্ত হয়। রাষ্ট্রীয় মদতে গুণ্ডাবাজ মুসলমানরা হিন্দু ও বৌদ্ধদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও নারী ধর্ষণ। এর সঙ্গে থাকে ধর্মান্তরকরণ।

১৯৪৯-এর আগস্ট থেকে ১৯৫০-এর ১৮-ই মার্চ পর্যন্ত হিন্দুদের উপর সংঘটিত পাশবিক অত্যাচার ও খুনের (One-sided diabolical killing and persecution of Hindus by Muslims.) তথ্যনিষ্ঠ বর্ণনা দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আইন সভার বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ (সর্বশ্রী বসন্তকুমার দাস; গণেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য, মুণীন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য, হারাণচন্দ্র ঘোষ দস্তিদার এবং মনোরঞ্জন ধর)-প্রধানমন্ত্রী লিকায়ত আলির কাছে এক স্মারকলিপি দেন। তাঁরা এই স্মারকলিপিতে উল্লেখ করেন যে,

১৯৪৯-এর আগস্ট মাসে সিলেট জেলার বিয়ানি বাজার ও বরলেখা থানায় একতরফা ভাবে হিন্দু নিধন শুরু হয়। অবস্থা চরমে পৌঁছায় '৫০-এ ফেব্রুয়ারীতে। ফেব্রুয়ারীর ৬ তারিখ রাতে এবং ৭ তারিখ বিকেলে রেডিও পাকিস্তান থেকে বারবার প্রচারিত একটি ঘোষণায় বলা হয়-"ভাইসব, আপনারা শুনেছেন পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতে আমাদের মুসলমান ভাইদের উপর অমানবিক অত্যাচার করা হচ্ছে। আপনারা কি প্রস্তুত হবেন না? আপনারা কি শক্তি সঞ্চয় করবেন না? ১০-ই' ফেব্রুয়ারী সকালে চারজন মহিলার হাতে শাঁখা, কপালে সিঁদুরের টিপ পরিয়ে এবং তাঁদের কাপড়ে লাল রঙ লাগিয়ে ঢাকা সেক্রেটারিয়েটের চারিদিকে ঘোরানো হয়। বলা হয় যে, কোলকাতায় এদেরকে হিন্দু বানিয়ে এদের উপর অত্যাচার করা হয়েছে। বেলা ১১টার সময় সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীবৃন্দ অফিস ত্যাগ করে ভিক্টোরিয়া পার্কে সমবেত হয়ে সভা করে। ওই সভা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুহত্যা এবং হিন্দুদের দোকান ও বাড়িঘর লুঠপাঠ শুরু হয়ে যায়। সঙ্গে অগ্নিসংযোগ ও নারীধর্ষণ। ট্রেন ও স্টিমারে করে যে সব হিন্দুরা ঢাকায় আসছিলেন, স্টেশনে তাদেরকে খুন করা হয়। প্রায় ৭ ঘণ্টা ধরে একতরফা ধ্বংসলীলা চলার পরে মিলিটারী নামে। দেশের সর্বত্রই অনুরূপ ঘটনা ঘটে।

স্মারকলিপিতে ঢাকা ছাড়াও সিলেট, ময়মনসিংহ, বাখরগঞ্জ, চিটাগাং, নোয়াখালি, ত্রিপুরা জেলায় সংগঠিত পাশবিক অত্যাচারের বর্ণনা দেওয়া হয় এবং এর প্রতিকার ও প্রতিবিধানের জন্য ২২-দফা পরামর্শ দেন পূর্বোক্ত নেতৃবৃন্দ। লিয়াকত আলী সাহেব স্মারকলিপিটি গ্রহণ করে হিন্দুদের কৃতার্থ করেন মাত্র। (শ্রীদেবজ্যোতি রায়-কেন উদ্বাস্তু হতে হল-পৃঃ ৩৩-৩৪)

আরো জানুনঃ নোয়াখালী দাঙ্গা: এক পরিকল্পিত দাঙ্গার ইতিহাস

যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ও পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা

ডঃ ভীমরাও রামজী আম্বেদকর ও যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ছিলেন ভারতের তফসিলী ও দলিত সম্প্রদায়ের দুই শ্রদ্ধেয় নেতা। উভয় নেতাই রাজনীতিতে মুসলিম লীগের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা পেয়েছিলেন। ডঃ আম্বেদকর ছিলেন দূরদ্রষ্টা, বিদগ্ধ। বিশ্বরাজনীতি, মুসলমানের ধর্ম ও ইতিহাস সম্বন্ধে তাঁর ছিল গভীর ব্যুৎপত্তি ও প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য। দলিত-মুসলিম ঐক্য শ্লোগানে তিনি বিভ্রান্ত হননি। পক্ষান্তরে দলিত-মুসলিম ঐক্যের প্রধান প্রবক্তা যোগেন মন্ডলের সঙ্গে মুসলিম লীগের ছিল নিবিড়তম সম্পর্ক। তিনি আন্তরিক ভাবেই বিশ্বাস করতেন যে উচ্চবর্ণের হিন্দুরাই দলিতদের ঘোরতর শত্রু। তাই এদের বিরুদ্ধে দলিত-মুসলিম-মিলনের মধ্যেই রয়েছে দলিতদের মুক্তির নিশ্চিত সম্ভাবনা। বস্তুত এই বিশ্বাস-ই ছিল তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি স্বরূপ। দলিতরাও ধর্ম ও জাতিতে হিন্দু এবং অ-মুসলমান মাত্রে মুসলমানের নিকট ঘৃণ্য ও বধ্য-এই সহজ সরল সত্যকে তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি। পাকিস্তান আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক যোগেন মন্ডল মুসলিম লীগের সদস্য পদ গ্রহণ করে পাকিস্তানকেই স্বদেশ রূপে গ্রহণ করেন। দেশ ভাগের পর '৪৭-সালের ৮-ই আগস্ট তিনি দিল্লি থেকে করাচী পৌঁছান।

১৯৪৭ হিন্দু গণহত্যার ইতিহাস - পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ)
বলদেন্দ্রনাথ ওরফে যোগেন্দ্রনাথ রায়

৪৭ সালের ১০-ই আগস্ট পাকিস্তানের সংবিধান সভার অধিবেশন বসে। সভার সদস্য সংখ্যা ৬৯। মুসলমান-৫০, হিন্দু-১৭ ও শিখ-১। হিন্দুদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সর্বশ্রী কিরণ শংকর রায়, ভীমসেন সাচার, বীরেন্দ্র কুমার দত্ত, অধ্যাপক স্যার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ। শিখ সদস্যদ্বয় ছিলেন অনুপস্থিত। সভার প্রারম্ভেই লিয়াকত আলির প্রস্তাব ও খাজা নাজিমুদ্দিনের সমর্থনে যোগেন মণ্ডল সর্বসম্মতিতে সভার অস্থায়ী সভাপতি নির্বাচিত হন। সমবেত সদস্যদের করতালির মধ্যে তিনি সভাপতির আসন গ্রহণ করেন।

যোগেনবাবু তাঁর ভাষণে বলেন:

আজ ইতিহাসের এই স্মরণীয় মুহূর্তে আমি পাকিস্তানের স্রষ্টা ও স্থপতি কায়েদ আজম জিন্নার প্রশংসা করি মুক্তকণ্ঠে (প্রবল হর্ষধ্বনি) : তাঁর প্রতি জ্ঞাপন করছি গভীর কৃতজ্ঞতা।...একথা বলা বাহুল্য যে মিঃ জিন্না বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র নায়ক। ... নবজাত রাষ্ট্রের পক্ষে ইহা এক শুভ সংকেত যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজনকে সভার অস্থায়ী সভাপতি নির্বাচন করা হয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র হল ন্যায়সঙ্গত দাবির জন্য ভারতের মুসলমানদের অবিরাম নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের সার্থক ফলশ্রুতি। (Referring to Mr. Jinnah, Mr. Mondal said: "I must express on this momentous occasion my gratitude to and admiration of Qaid-e-Azam Mohammed Ali Jinnah (Cheers), the great architect and creator of the state of Pakistan...It is needless for me to reiterate that Mr. Jinnah is the greatest statesman and one of the greatest men in the world to-day.... The election of temporary chairman from the members of the minority community augurs very well for the state. The creation of Pakistan today is the result of the persistent and legitimate demands of a minority community; namely the Muslims of India.")

পূর্ব পাকিস্তানের এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর পাকিস্তান সরকারের আইন ও শ্রম বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল দাঙ্গা-বিধ্বস্ত অঞ্চলসমূহ পরিদর্শন করে মর্মাহত হন। হয়তো অতীতের ভ্রান্ত রাজনীতির জন্য হয় অনুশোচনা। পাকিস্তান সম্বন্ধে তাঁর ঘটে মোহ মুক্তি। পঃ পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার পথে তিনি কলকাতা বিমান বন্দরে অবতরণ করেন-সেখান থেকেই পাঠিয়ে দেন পদত্যাগ পত্র। এই সুদীর্ঘ পত্রখানির গুরুত্ব বিবেচনা করে-নির্বাচিত অংশ সংক্ষেপে নিচে উদ্ধৃত হল:


প্রিয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয়,

পূর্ব বাংলার অনগ্রসর হিন্দু জনগণের উন্নতি সাধন আমার জীবন সাধনা। উদ্দেশ্য সাধনের ব্যর্থতায় আমি চরম হতাশাগ্রস্ত। তাই গভীর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আপনার মন্ত্রী পরিষদ থেকে পদত্যাগ করছি। ভারত-পাক উপমহাদেশের ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে যে সকল কারণ আমাকে পদত্যাগে প্রণোদিত করেছে-তার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া সঙ্গত বলে আমি মনে করি।

....১৯৪৬ সালের মার্চে সাধারণ নির্বাচনের পর সুরাবর্দির নেতৃত্বে বাংলায় লীগ মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। সে মন্ত্রীসভায় আমাকেও নেওয়া হয়েছিল। ওই বৎসরই ১৬-ই আগস্ট মুসলিম লীগ Direct Action Day-রূপে পালন করে। আপনি অবগত আছেন, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম (Direct Action) কার্যত নির্বিচার হিন্দু-হত্যায় পর্যবসিত হয়। হিন্দুরা মন্ত্রীসভা থেকে আমার পদত্যাগ দাবি করে। আমি জীবন বিপন্ন বোধ করি। হত্যার হুমকি দিয়ে লেখা অনেক চিঠি আমি প্রতিদিন পেতাম। কিন্তু আমি অবিচলিত। জীবন বিপন্ন করেও আমাদের মুখপত্র 'জাগরণের" মাধ্যমে আমি তফশিলী সম্প্রদায়ের নিকট আবেদন রাখি-তারা যেন কংগ্রেস-লীগ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থেকে নিজেদের দূরে রাখেন। এ কথা আমি সকৃতজ্ঞ অন্তরে স্মরণ না করে পারি না যে, সেদিন ক্রুদ্ধ হিন্দু-জনতার হাত থেকে প্রতিবেশী উচ্চবর্ণের হিন্দুরাই আমার প্রাণরক্ষা করেছিলেন। কলকাতার পর নোয়াখালিতে অনুষ্ঠিত হয় অনুরূপ দাঙ্গা। নিহত হয় অগণিত হিন্দু। শত শত হিন্দুকে করা হয় ধর্মান্তরিত। অপহৃতা ও ধর্ষিতা হন বহু হিন্দু নারী। দাঙ্গার পরই আমি ত্রিপুরা ও ফেনীর দাঙ্গা-পীড়িত এলাকা পরিদর্শন করি। হিন্দুদের উপর যে ভয়ংকর নির্যাতন হয়েছে তাতে আমি শোকাহত। তা সত্ত্বেও মুসলিম লীগের সঙ্গে আমার সহযোগিতার সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ ছিল। কলকাতায় হিন্দু-নিধনের পরই সুরাবর্দি মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে আনা হয় অনাস্থা প্রস্তাব। বাংলার বিধান সভায় তখন কংগ্রেস সমর্থক ৪ জন এ্যাংলো ইন্ডিয়ান ও ৪ জন তফশিলী বিধায়ক ছিলেন। আমার একান্ত চেষ্টায় তারা অনাস্থা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেয়। অন্যথায় মন্ত্রীসভার পরাজয় ছিল অনিবার্য।...

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, বাংলাকে দ্বি-খণ্ডিত করার প্রস্তাবের আমি ছিলাম ঘোরতর বিরোধী। বাংলা-বিভাগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে শুধু যে সকলের কাছ থেকে প্রবল বাধা পেয়েছি তাই নয়; শুনতে হয়েছে অকথ্য গালিগালাজ এবং সহ্য করতে হয়েছে চূড়ান্ত অপমান। অনুতাপ-অনুশোচনার সঙ্গে সেই দিনগুলির কথা স্মরণে আসে যখন এই উপমহাদেশের ৩২ কোটি হিন্দু আমার বিরুদ্ধে ছিল এবং আমাকে চিহ্নিত করেছিল হিন্দু ও হিন্দুধর্মের শত্রুরূপে। ... ঢাকায় নয়দিন অবস্থান কালে আমি ঢাকা ও তার সন্নিহিত দাঙ্গা-বিধ্বস্ত এলাকাগুলি পরিদর্শন করি।... ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা চট্টাগ্রাম রেলপথে শত-শত হিন্দু-হত্যায় আমি মর্মাহত। ... বরিশালে পৌঁছে দাঙ্গার যে চিত্র আমি পেয়েছি তা আমাকে স্তম্ভিত করেছে। আমি বুঝতে পারি না যে জেলা সদর থেকে মাত্র ৬ মাইল দূরে কাশীপুর, মাধবপাশা ও লাকুটিয়ায় এরকম ভয়াবহ দাঙ্গা কিভাবে হতে পারে। মাধবপাশা জমিদার বাড়িতেই ২০০ হিন্দুকে হত্যা করা হয়। আহতের সংখ্যা ৪০। মুলাদিতে দেখেছি নরকের বীভৎসতা। মুলাদি বন্দরেই (পাট-গুদামে) হত্যা করা হয় ৩০০ হিন্দুকে।... পুরুষদের নির্বিচারে হত্যা করে হিন্দু-যুবতীদের লুণ্ঠিত দ্রব্যের ন্যায় উপঢৌকন দেওয়া হয় হত্যা-কাণ্ডের নায়কদের।.....

মার্চের শেষদিকে শুরু হয় হিন্দুদের দেশান্তর-যাত্রা, ব্যাপকভাবে। মনে হল যেন অনতিবিলম্বেই সকল হিন্দু পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে যাবে। ভারতে সৃষ্টি হয় তীব্র প্রতিক্রিয়া-ওঠে রণ-হুংকার। পরিস্থিতি খুবই সঙ্কটজনক। একটা জাতীয় বিপর্যয় যেন অবশ্যম্ভাবী। অনিবার্য দুর্যোগ এড়াতে স্বাক্ষরিত হল দিল্লিচুক্তি।

দিল্লিচুক্তির ৬ মাস পরেও পাকিস্তানে ও বিদেশে হিন্দু-বিদ্বেষী ও ভারতে বিরোধী প্রচার অব্যাহত। সমগ্র পাকিস্তানে "কাশ্মীর দিবস" পালন সেই সাক্ষ্যই বহন করে। ভারতে বসবাসকারী মুসলমানের নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর প্রয়োজন-পাঞ্জাবের (পাক) রাজাপালের এই সাম্প্রতিক বিবৃতিতে ভারতের প্রতি পাকিস্তানের প্রকৃত উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট।

পূর্ববাংলার অবস্থা আজ কিরূপ? ইতিমধ্যেই ৫০ লক্ষ হিন্দু দেশত্যাগ করেছে। ....স্বদেশে হিন্দুরা আজ "রাষ্ট্রহীন"-প্রবাসী। তাঁদের একমাত্র অপরাধ-ধর্মে তাঁরা হিন্দু। আমার সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত, পাকিস্তানে হিন্দুদের কোন স্থান নেই। তাঁদের ভবিষ্যৎ গাঢ় তমসায় আচ্ছন্ন হয় ধর্মান্তর অথবা অস্তিত্ব লোপ।...

পাকিস্তানের সামগ্রিক অবস্থা-হিন্দুদের প্রতি চরম নৃশংসতার কথা বাদ দিলেও আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও কম বিষাদ-তিক্ত ও ইঙ্গিতবহ নয়। সংসদীয় দলের নেতা ও প্রধান মন্ত্রী রূপে আপনি গত ৮-ই সেপ্টেম্বর আমাকে এক বিবৃতি দিতে বাধ্য করেছিলেন। আপনি জানেন অসত্য এবং তার চেয়েও ঘৃণ্য অর্ধসত্যের উপর ভিত্তি করে কোন বিবৃতি দানে আমি সম্মত ছিলাম না।...এই ভণ্ডামী ও অসত্যের গুরুভার অসহনীয়। বিবেকের দংশনে আমি জর্জরিত। তাই মন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং আপনার হাতে তা অর্পণ করছি। আশা করি, বিলম্ব না করে আপনি তা গ্রহণ করবেন। আপনি অবশ্য এই শূন্যপদ এমন ভাবে পূরণ করবেন যা আপনার ইসলামিক রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সাধনে হবে সহায়ক ও সঙ্গতিপূর্ণ।

৮ আগস্ট, ১৯৫০
ইতি বিনীত
জে. এন. মন্ডল

ইংরেজিতেঃ

 

১৯৫০ সালের বিধ্বংসী দাঙ্গার (একতরফা) পর পূঃ পাকিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দুর নর-নারী লাঞ্ছিত উৎপীড়িত ও সর্বস্বান্ত হয়ে পঃ বাংলায় আশ্রয় নেয়। তখন এ বঙ্গে আন্দোলন আরম্ভ হল যে যত সংখ্যক হিন্দু পূর্ববঙ্গ হতে বিতাড়িত হয়েছে, সেই সংখ্যক মুসলমানকে পূর্ববঙ্গে পাঠিয়ে হিন্দু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক; যেমন হয়েছে পাঞ্জাবে। 'ইহাতে ক্রুদ্ধ হইয়া প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু গান্ধীর প্রতিধ্বনি করিয়া বলিলেন যে,

ইহা ধর্ম নিরপেক্ষ ভারত-রাষ্ট্রে (secular state of India) অসম্ভব।

প্রধানমন্ত্রী, বিধান চন্দ্র রায়কে (পঃ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী) নির্দেশ দিলেন,

পূর্ববঙ্গ হইতে উদ্বাস্তুদের পঃ বঙ্গে আশ্রয় দেওয়া বন্ধ করিতে হইবে"।


ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে

"যে দুইখানি চিঠিতে নেহেরু এই অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন তাহা চিরকাল মহাত্মা-গান্ধী ও পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর দুরপনেয় কলঙ্ক ও নিষ্ঠুরতার চরম নিদর্শন বলিয়া গণ্য হইবে।"

১৯৫০ সালের পরেও পরিকল্পনামাফিক ৩/৪ বৎসর অন্তর অনুষ্ঠিত হয় হিন্দু হত্যা। চরম নৃশংস অত্যাচার ও নির্যাতনে সর্বস্ব হারিয়ে অগণিত হিন্দু এসেছে (এখনও বিরাম নেই) হিন্দুস্থানে। কিন্তু বাঙালী হিন্দু উদ্বাস্তুর পুরবাসনে অনুসৃত কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি লক্ষণীয়। সত্যিকারের পুনর্বাসন তাদের হয়নি। দণ্ডকারণ্য আন্দামান হতে আরম্ভ করে ভারতের সর্বত্র বাঙালী হিন্দু উদ্বাস্তুরা কুকুর-বিড়ালের ন্যায় বিতাড়িত হয়েছে। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসের সে এক কলঙ্কিত অধ্যায়। রমেশ চন্দ্র মজুমতদার যথার্থই বলেছেন-

মহাত্মা গান্ধীর জাতীয় আদর্শ ও পণ্ডিত নেহেরুর ভাবোচ্ছাসের যুপকাষ্ঠে যে কোটি কোটি বাঙালীর বলিদান হয়েছে, বাঙালী যদি কখনও মনুষ্যপদবাচ্য হয় তবে ইহার জবাবদিহি চাহিবে"। এ অভিযোগের যৌক্তিকতা স্বীকার করেও বলতে হয় এ ব্যাপারে বাঙালীর দায়িত্বও কম নয়। পঃ পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত হয়ে হিন্দু-শিখ পাঞ্জাবে এসে পূর্নবাসনে নিজেরাই বাস্তবোচিত সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে। ভিক্ষাপাত্র নিয়ে তারা নেহেরু সরকারের করুণা প্রার্থনা করেনি। সরকার বাধ্য হয়েছে উদ্বাস্তুদের সর্বপ্রকার সাহায্য দিতে। পাঞ্জাব আজ সাম্প্রদায়িক সমস্যা হতে মুক্ত। আর বাঙালী হিন্দু? গান্ধীর হিন্দু-মুসলিম মিলনের নেশায় বিভোর। পূর্ব পাকিস্তানে সর্বস্বান্ত হয়ে এ বঙ্গে এসে আশ্রয় নিয়েছে কলকাতার ফুটপথ, ধুবুলিয়া অথবা রানাঘাট ক্যাম্পে। তারা যদি পাঞ্জাবের হিন্দু-শিখদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করত তবে উদ্বাস্তু সমস্যার হত স্থায়ী ও বাঞ্ছিত সমাধান। মিলনের নেশা বাঙালী হিন্দুর এখনও কাটেনি বরং বেড়েছে। তাই এ বঙ্গ থেকেও পুনরায় বিতাড়ন হয়তো অনিবার্য। দৃষ্টান্ত হিন্দু-শূন্য কাশ্মীর।

পাকিস্তান বিশেষত পূঃ পাকিস্তানের হিন্দুদের প্রতি পণ্ডিত নেহেরু ও কংগ্রেসের বহু-শ্রুত, বহুল প্রচারিত প্রতিশ্রুতির কথা সর্বজনবিদিত। উপরিউক্ত চিঠি ও নেহেরু-লিয়াকত চুক্তিতে তার স্বরূপ সুস্পষ্টভাবে উদ্‌ঘাটিত। পূঃ পাকিস্তানে মুসলমান রাষ্ট্রীয় মদতে এত বড় হিন্দু-মেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন করল-তার বিরুদ্ধে কংগ্রেস ও ভারত সরকারের কোন নিন্দা বা প্রতিবাদ নেই। বরং পণ্ডিত নেহেরু পাক প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলিকে আলোচনার জন্য দিল্লি আসার আমন্ত্রণ জানান। সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে হিন্দু-হত্যাকারী লিয়াকত আলি রাষ্ট্রীয় অতিথিরূপে সাত দিন ছিলেন দিল্লিতে। সম্পাদিত হয় দিল্লিচুক্তি। হিন্দু-বিদ্বেষের যে ঐতিহ্য ভারত বিভাগকারী পণ্ডিত নেহেরু সৃষ্টি করেছেন-নেহেরু-লিয়াকত আলি চুক্তি (দিল্লি চুক্তি) তাতে এক নবতম সংযোজন। বাক্‌চাতুর্যে পূর্ণ, অন্তঃসারশূন্য এই চুক্তির দুটি অংশ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চুক্তির মুখবন্ধে বলা হয়:

ভারত ও পাকিস্তান সরকার নিজ নিজ দেশে ধর্মমত নির্বিশেষে সংখ্যালঘুদের সমান নাগরিক অধিকার প্রদানে সম্মত। উভয় সরকারই সংখ্যালঘুদের ধন-মান-জীবন ও সাংস্কৃতিক অধিকারের পূর্ণ-নিরাপত্তার সুব্যবস্থা করতে বিবিসম্মতভাবে দায়বদ্ধ। (The Government of India and Pakistan solemnly agree that each shall ensure to the minorities throughout its territory complete equality of citizenship, irrespective of religion; a full sense of security in respect of life, culture, property and personal honour.)'

ভারত ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র-ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তান। উদ্দেশ্য ও আদর্শ স্বতন্ত্র। কিন্তু চুক্তির বয়ান অনুযায়ী ভারত পাকিস্তান সমপর্যায়ভুক্ত হল। পূর্ব পাকিস্তানে যে ভয়াবহ হিন্দু-নিধনের পটভূমিকায় এই চুক্তি সম্পাদিত হয়, চুক্তির কোথাও তার আভাষমাত্র নেই। এর তাৎপর্য হল পূর্ব পাকিস্তানে যদি হিন্দু নিগৃহীত-ভারতে মুসলমানেরও একই অবস্থা। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীত। পূর্ব পাকিস্তানের দাঙ্গার কোন প্রতিক্রিয়া এ বঙ্গে হয়নি। কূটনীতির বিচারে এই চুক্তি ভারতের এক বিরাট পরাজয়।


চুক্তির C-7-নং ধারায় বলা হয়ঃ

যদি কোন সংবাদপত্র, বেতার, ব্যক্তি বা সংগঠন সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দুরভিসন্ধিমূলক কোন মতবাদ বা সংবাদ প্রচার করে তবে তা বন্ধের উদ্দেশ্যে তৎক্ষণাৎ কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; অপরাধীর বিরুদ্ধে নিতে হবে কঠোর ব্যবস্থা। (Take prompt and effective steps to prevent the dissemintion of news and mischievous opinion calculated to rouse communal passion by press or radio or by any individual or organisation. Those guilty of such activity shall be rigorously dealt with.)'

এই ধারাটির প্রকৃত উদ্দেশ্য হল পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু-বিরোধী দাঙ্গার সংবাদ যেন ভারতের সংবাদপত্রে প্রকাশিত না হয়। অধ্যাপক সমর গুহ যথার্থই বলেছেন: দিল্লী চুক্তি ও অন্তঃরাষ্ট্র সংবাদ মাধ্যমে চুক্তি পূঃ পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে প্রকৃত চিত্র দেশবাসদের অগোচরে রাখতে সফল হয়।

Durga das (Rupa & Co.) প্রণীত-India from Curzon to Nehru and After-থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে শ্রীদেবজ্যোতি রায় লিখেছেন:

অন্তত ৪ জন বিশেষ দায়িত্বপূর্ণ মন্ত্রী সেদিন নেহেরু-লিয়াকত চুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন। এঁরা হলেন সর্দার প্যাটেল, ডঃ আম্বেদকর, ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ও ক্ষিতীশচন্দ্র নিয়োগী। প্যাটেল শেষ পর্যন্ত নেহেরুকে সমর্থন করেছিলেন। ডঃ আম্বেদকর নীরব ছিলেন এবং ডঃ মুখার্জী ও শ্রীনিয়োগী মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন।......

নেহেরু লিয়াকৎ চুক্তির উপরে ভারতের পার্লামেন্টে দীর্ঘ আলোচনা হয় ১৯৫০-এর আগস্ট মাসে। পণ্ডিত নেহেরু সুদীর্ঘ ভাষণ দিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন। সেদিন বিরোধী দলনেতা ডঃ মুখার্জী উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানের জন্য তিনটি পথ দেখিয়েছিলেন-

  • ১-ভারত ও পাকিস্তানের পুনর্মিলন
  • ২-সংখ্যালঘু বিনিময়
  • ৩-ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা পুনর্নির্ধারণ।

জবাবী ভাষণে পণ্ডিত নেহেরু বলেছিলেন যে, ১ ও ৩ নং পথে অগ্রসর হওয়ার অর্থ যুদ্ধ করা। আমরা যুদ্ধ করতে প্রস্তুত নই। ২-নং পথে যাওয়ার অন্তরায় দুটোঃ

  • (ক) অর্থের অভাব এবং
  • (খ) এ পথ ভারতের ঐতিহ্যের পরিপন্থী।

(It is completely opposed to our political, economic, social and spiritual ideals. If you want to have an exchange of population, then you must change the whole basis of not only this government but of all that we have stood for this thirty odd years and during the movement for freedom in this country.)-Jawaharlal Nehru's speeches (1949-1953) Govt. of India publication.)


পণ্ডিত নেহেরুর এই পাণ্ডিত্যপূর্ণ মানবিক ভাষণ সেদিন পূর্ববঙ্গে আটকে পড়া প্রায় দেড়কোটি সংখ্যালঘুকে এমন একটি নরকে নিক্ষেপ করেছিল যেখানকার নিত্য সঙ্গী হচ্ছে "হত্যা, লুণ্ঠন আর নারীধর্ষণ"। এর বিকল্প ছিল ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়া। আমরা যারা এসব সহ্য করতে পারিনি বা পারছি না তারাই এখানে চলে এসেছি এবং এখনও আসছি। ওখানকার শেষ হিন্দু ও বৌদ্ধটি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করা পর্যন্ত এই চলে আসা অব্যাহত থাকবে।"

সমকালে ও পরবর্তীকালে দিল্লি-চুক্তির তীব্র সমালোচনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংবিধান বিশেষজ্ঞ এন. সি. চ্যাটার্জী এই চুক্তি ও নেহেরুর ভূমিকা সম্বন্ধে যে পর্যালোচনা করেছেন, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, বাস্তব পরিস্থিতি, সমসাময়িক ও বর্তমান রাজনৈতিক পটভূমিকায় তা খুবই মূল্যবান। নিচে তার বঙ্গানুবাদ দেওয়া হলঃ


ভারতের কতিপয় নেতা সাম্প্রদায়িকতার আতঙ্কে ভুগছেন। অন্ধ তাঁরা। অন্ধ চোখে দূরবীন লাগিয়েছেন বলেই তাঁরা যথাযথ পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রদায়িকতার মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রশ্ন হল-প্রকৃত সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কে সাহায্য করছে? এর্নাকুলামে পণ্ডিত নেহেরু ভারত-পাক চুক্তির বিরোধীদের সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়েছেন। যাঁরা প্রকৃত ঘটনা জানেন, তাঁরা "বিরাট জয় হয়েছে" নেতৃবৃন্দের এই আত্মতুষ্টিতে কৌতুক বোধ করবেন। এই সকল আত্মসন্তুষ্ট নেতৃবৃন্দের অভিযোগ যে বিরোধীরা সাফল্যকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করতে চাইছে।

সত্য ঘটনা হল এই চুক্তি ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের এক বিরাট জয়। যে শক্তি ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে সংখ্যালঘুদের বিতাড়নে বদ্ধ পরিকর, এই চুক্তিতে তারাই জয়ী হয়েছে। পণ্ডিত নেহেরু বলেছেন তাঁর কর্তব্য হবে সমালোচকদের বিরোধিতা করা এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সর্বদা ও সর্বত্র সংগ্রাম করা। পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ এখনও দ্বি-জাতি তত্ত্বের মহিসা প্রচার করে রাজনীতিতে তার যথাযথ প্রয়োগ করছে। আমাদের সবিনয় জিজ্ঞাসা-পণ্ডিত নেহেরু কি এই মুসলিম লীগের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আগ্রহী? আমাদের জিজ্ঞাসা-সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার সময় থেকে মুসলিম লীগকে তোষণ করে সাম্প্রদায়িকতাকে কে প্রশ্রয় দিয়েছে?

বাংলার বর্তমান সমস্যা সাম্প্রদায়িক নয়, রাজনৈতিক। যে সাম্প্রদায়িক শক্তি বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ করে ভারতের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় সংহতিকে ধ্বংস করেছে, তার নিকট জাতীয় নেতৃত্বের দুর্ভাগ্যজনক আত্মসমর্পণের এ হল প্রত্যক্ষ ও অনিবার্য ফলশ্রুতি। সেই শক্তি পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘুদের বিতাড়ন করে সমধর্মাবলম্বীদের (মুসলমান) নিয়ে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রগঠনের চেষ্টা করছে। মহম্মদ আলি জিন্না বলেছেন, সমজাতীয় চরিত্রের ওপর পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাফল্য নির্ভর করবে। মুসলিম লীগ অ-মুসলমানদের বিতরণ করে সেই ঘোষিত লক্ষ্যই সাধন করছে। এই নীতিরই নিদারুণ পরিণতি-লক্ষ মানুষের দেশান্তর, রক্তপাত, নারীর লাঞ্ছনা ও কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি বিনাশ।

পাক-ভারত চুক্তির উদ্যোক্তা ও প্রবক্তারা যেন স্মরণ রাখেন, কোটি কোটি স্বদেশবাসী সঙ্গত কারণেই বিশ্বাস করে যে, এই চুক্তি কার্যত সেই প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উৎসাহিত ও সাহায্য করবে যাঁরা শুধু ভারত ভাগ করইে ক্ষান্ত হয়নি-দেশব্যাপী রক্ত-বন্যা বইয়ে দিয়ে ভারতে সৃষ্টি করেছ ঘোরতর অরাজকতা। ত্রিবান্দ্রম ভাষণে প্রধান মন্ত্রী ভারতের ঐক্যবিরোধী বিভেদকামী বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে সতর্ক করেছেন। যাঁরা ভারত ভাগ করেছেন এবং সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে সৌহার্দ্য স্থাপনে একান্তই আগ্রহী, যে পাকিস্তানের ভিত্তি হল হিন্দু ও তাঁর সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতি সীমাহীন বিদ্বেষ, তাঁদের মুখে ভারত-ঐক্যের কথা নিতান্তই অশোভন। সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত বিভাগ কি এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে?

পণ্ডিত নেহেরু তাঁর অনবদ্য আত্মজীবনীতে মুসলিম লীগকে বলেছেন,

"গোঁড়া, আগ্রাসী ও জাতীয়তা-বিরোধী"।

অথচ আশ্চর্য, তিনি ও তাঁর সহকারীবৃন্দ এই প্রতিক্রিয়াশীল ও জাতীয়তা-বিরোধী মুসলিম লীগের নিকট আত্মসমর্পণ করেছেন। জনসম্মোহনী বাগ্মিতাপূর্ণ ভাষণ ও জাতীয় ঐক্যের শ্লোগানে জনমানসে চমক সৃষ্টি করা যায়। (কিন্তু) যুদ্ধ বিরোধী আবেগপূর্ণ বক্তৃতার দ্বারা আমরা যেন কাপুরুষতাকে আড়াল করার চেষ্টা না করি। কাশ্মীরে কি যুদ্ধ হয়নি? আগ্রাসী পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে ভারত কি রক্তশূন্য হয়নি?

আমরা সকলেই শান্তিকামী-শান্তির জন্য উদ্‌গ্রীব। কিন্তু সে শান্তি হবে অবশ্যই সম্মানজনক। এই মর্যাদার সঙ্গে শান্তি কি সম্ভব যদি আমরা ভুলে যাই, কোন সংগঠন যদি বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার জন্য দায়ী হয় তবে তা হল মুসলিম লীগ। ইহা খুবই পরিতাপের বিষয় যে, ইতিহাসের চরম সঙ্কট মুহূর্তে আমাদের নেতৃবৃন্দ ঘৃণ্য-বিদ্বেষ ও সংঘবদ্ধ হিংসায় মদতপুষ্ট মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিরোধের চেষ্টা করেননি।

শান্তিপূর্ণ ভারত গঠন ও ভারতকে দুর্বল করার যে কোন অশুভ প্রয়াসকে প্রতিহত করতে হবে-এ বিষয়ে পণ্ডিত নেহেরুর সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করি। কিন্তু প্রশ্ন হল (হিন্দু) বিদ্বেষ যাদের শক্তিমত্তার মূল ভিত্তি এবং যাঁরা এই অমানবিক বর্বরতার জন্য দায়ী, তাঁদের সঙ্গে সন্ধি ও চুক্তি করে কি শক্তিশালী ভারত গঠন সম্ভব? আর্থিক বিপর্যয়ে পাকিস্তান যখন বিপন্ন-এই চুক্তি তাকে সেই ঘোর সঙ্কট থেকে উদ্ধার করেছে। সঙ্কট মুহূর্তে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের দ্বিধা-দুর্বলতা ও মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রবল অনীহাই ভারতকে দুর্বল করবে। যাঁরা প্রকৃতই কামনা করে যে, হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করে, নির্যাতিত মানুষের পরিত্রাতারূপে শক্তিশালী নবভারতের আবির্ভাব হোক-তাঁরা এই তোষণ নীতির ঘোরতর বিরোধী। তাঁরাই ভারতের ঐক্য ও সংহতির ধারক। এই চুক্তিতে পাকিস্তানেরই জয় হয়েছে। পাকিস্তান যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। দক্ষ রাজনীতিবিদ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। চুক্তিতে তিনি ভারতকে পাকিস্তানের সমপর্যায়ে নামিয়ে আনতে সফল হয়েছেন। দিল্লি চুক্তির সাহায্যে তিনি তাঁর দেশের বিপর্যস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন করে ভারতের বিরুদ্ধে যথারীতি অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। পরিতাপের বিষয় হল চরম অপমানেও আমাদের নেতৃবৃন্দ হিন্দু ও ভারত-বিরোধী অশুভআগ্রাসী শক্তিকে সর্বত্র দূরে থাক্ কোথাও প্রতিরোধের চেষ্টা পর্যন্ত করেননি। বরং তাঁরা মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে উষ্ণ করমর্দন ও গাঢ় আলিঙ্গন করে নিজেদের ধন্য মনে করেন। যদিও দুষ্কর্মের জন্য তাঁদের নেই কোন অনুশোচনা। তাঁরা (ভারতীয় নেতৃবৃন্দ) ভারতমাতার একনিষ্ঠ সেবকদের পাঠিয়েছে কারাগারে। যাঁদের মধ্যে অনেকেই ব্রিটিশের বিরুদ্ধে স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে-যখন ভারতের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর নিকট স্বাধীনতা ছিল স্বপ্নাতীত।

গভীর পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয় যে, পণ্ডিত নেহেরু ও তাঁর সহকর্মীদের ভূমিকা প্রতিক্রিয়াশীল, উগ্র, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতাকেই শক্তিশালী করবে। যদি তিনি যথার্থই সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী হন তবে তাকে কার্যক্রম ও নীতির পরিবর্তন করতে হবে। তাঁর প্রাক্তন সহকর্মী-হিন্দু অথবা খ্রীস্টান, তাঁদের বিরুদ্ধাচরণ অর্থহীন। যাঁরা পূর্ব-নির্ধারিত সুসংবদ্ধ পরিকল্পনা অনুযায়ী সংখ্যালঘু নির্যাতন করছে, পণ্ডিত নেহেরুর উচিত হবে দৃঢ়হস্তে তাঁদের মোকাবিলা করা। লক্ষ্য রাখতে হবে, আমাদের চিন্তা যেন এমন খাতে প্রবাহিত না হয় যা বিপর্যয়কে আমন্ত্রণ জানাবে। রাষ্ট্রীয় অর্থে মিথ্যা প্রচার ও স্তাবকদের সুললিত ভাষণের দ্বারা সত্যকে আড়াল করা যায় না।

গত ৬০ বৎসরে পাকিস্তান তিনবার ভারত আক্রমণ করেছে। মুসলিম জেহাদী গোষ্ঠীর সাহায্যে কাশ্মীরকে করেছে হিন্দুশূন্য। কিন্তু গান্ধী-নেহেরুর উত্তরসুরীরা ঐতিহ্যে অবিচল। তাদের মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান প্রীতি কিছুমাত্র হ্রাস হয়নি। তাই আজও পূর্ববঙ্গে র অবশিষ্ট হতভাগ্য হিন্দুরা 'ইসলামিক জেহাদের" সহজ শিকার। বিপন্ন তাদের জীবন ও ধন মান।


📕তথ্যসূত্র (References):

  • Guha, Samar. The Last Survivors of Partition.
  • Roy, Debojyoti. কেন উদ্বাস্তু হতে হল?
  • Mondal, Jogendra Nath. "Resignation Letter to Prime Minister Liaquat Ali Khan." (8th October, 1950).
  • The Statesman. (১৯৪৭-৫০)
  • The Dawn. (করাচি থেকে প্রকাশিত, ১৯৪৭-৫০)
  • The Hindustan Times.
  • Constituent Assembly of Pakistan Debates. (১০ আগস্ট, ১৯৪৭-এর অধিবেশন)
  • Nehru, Jawaharlal. "Address to the Nation." (১৫ আগস্ট, ১৯৪৭)
  • Patel, Sardar Vallabhbhai. "Address to the Nation." (১৫ আগস্ট, ১৯৪৭)
  • Mukherjee, Syama Prasad. "Statement on the Partition of Bengal." (২৬ জুলাই, ১৯৪৭)

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
Post a Comment (0)
To Top