মোহিনী একাদশী মাহাত্ম্য

2
মোহিনী একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য

মোহিনী একাদশীর মাহাত্ম্য

যুধিষ্ঠির-শ্রীকৃষ্ণ সংবাদে----

ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্রশ্ন করলেন, হে জনার্দন! বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষীয়া একাদশীর নাম ও মাহাত্ম্য বিস্তারিত বর্ণনা করুন । শ্রীকৃষ্ণ বললেন, হে ধৰ্ম্মপুত্র! ত্রেতাযুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র জনকনন্দিনী সীতাদেবীর বিরহে বড় দুঃখ পেয়েছিলেন । তখন তিনি মহর্ষি বশিষ্ঠের নিকট প্রশ্ন করেছিলেন এমন এক কোন শ্রেষ্ঠব্রত যা পালন করলে জীবের সমস্ত পাপ ও দুঃখ নিবৃত্তি হয়ে যায় । তখন বশিষ্ঠজী শ্রীরামচন্দ্রকে বলেছিলেন---হে রাম! আপনার বুদ্ধি শ্রদ্ধাযুক্ত আপনি অতি উত্তম প্রশ্ন করেছেন । আপনার নাম গ্রহণে ও স্মরণে জীবের পরম মঙ্গল সাধিত হয়, তথাপি আপনি সকল জীবের কল্যাণ কামনায় আমার নিকট সৰ্ব্বপাপনাশক ও দুঃখহারক ব্রতকথা জানতে চেয়েছেন । হে প্রভু! বৈশাখ মাসের শুক্লাপক্ষীয়া একাদশী, মােহিনী নামে প্রসিদ্ধ । এই একাদশী ব্রত সুষ্ঠুরূপে পালন করলে মনুষ্যের সকল পাপ ও সৰ্ব্বদুঃখ এবং মােহজাল নিবৃত্তি ঘটে । আপনি এই ব্রত-মহিমা একাগ্রচিত্তে শ্রবণ করুন ।

পুরাকালে সরস্বতী নদীর তীরে ভদ্রাবতী নামে এক মহানগরী ছিল, সেইনগরীতে দ্যুতিমান নামে এক রাজা বাস করতেন । তিনি সত্যপ্রতিজ্ঞ, ধৈৰ্য্যশীল ছিলেন । তার নগরীর প্রজাগণ মহাসুখে কালযাপন করত । বৈশ্যকুলজাত ধনাঢ্য ধর্মাত্মা ধনপাল নামে এক বিষ্ণুভক্ত ঐ রাজ্যে বাস করতেন ।

সেই মহাত্মা ধনপাল লােকহিতার্থে দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্নসত্র, জলপূর্ণকৃপ, সরােবর, পুষ্পৈদ্যান, ফলােদ্যান,বড়বড় রাস্তা, বিদ্যালয়, চিকিৎসালয় ও বিষ্ণুমন্দির নির্মাণ করে তার অর্থের প্রকৃত সদ্ব্যবহার করতেন । এইশান্তবিষ্ণুভক্তি-পরায়ণ বৈশ্যের পাঁচটি পুত্র ছিল । সর্বকনিষ্ঠ পুত্রের নাম ধৃষ্টবুদ্ধি, সে দুষ্টবুদ্ধিসম্পন্ন, অসৎ সঙ্গেরত, মদ্যপানে আসক্ত, ন্যূতক্রীড়া, জীবহিংসা, অধর্মাচরণ, অসতী বারনারীরসঙ্গকরে পিতৃমাতৃকুলের কলঙ্কস্বরূপ কুলাঙ্গাররূপে পরিগণিত হয়েছিল । সে দেবতা, অতিথি, পিতৃ-মাতৃ ও ব্রাহ্মণদের কিছুতেই সম্মান করত না ।

সে সর্বদাই পাপাসক্ত পাপকর্মে লিপ্ত, পাপচিন্তায় রত এবং অত্যন্ত ঘৃণ্য, জঘন্যভাবে জীবন যাপন করত । এই পাপিষ্ঠ দুরাচারপিতার ধনসর্বস্ব অসৎ কর্মে ব্যয় করতে লাগলাে । অখাদ্য, কুখাদ্যাদি গ্রহণ, মদ্যপানে বিভাের হয়ে থাকত । একদিন তার পিতা, এক দুষ্টা অসতী বেশ্যার গলদেশে হাত রেখে প্রকাশ্য চৌরাস্তায় দিবালােকে ওকে ঘুরে বেড়াতে দেখে অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে ত্যাজ্যপুত্র বলে গৃহ থেকে বহিস্কৃত করে দিলেন ।

সেই দিন থেকে সে পিতৃমাতৃ স্নেহ, ভাই-বন্ধু-আত্মীয়-স্বজনের স্নেহপাশ থেকে বঞ্চিত হয়ে এমনকি সমাজচ্যুত, জাতিচ্যুত, অপাংক্তেয় হয়ে সজ্জন সমাজ থেকে ঘৃণিত হয়ে পড়ল । তখন তার নিজ ব্যবহার্য্য বস্ত্র অলঙ্কারাদি বিক্রয় করে কোনমতে দিন কাটাতে লাগলাে । অভাবের তাড়নায় শরীর অত্যন্ত জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়ল । তাকে ব্যাধিগ্রস্ত ও ধনহীন দেখে দুষ্টা রমণীগণ ও তথাকথিত বন্ধুবান্ধবগণ নানাপ্রকার নিন্দা করতে করতে তাকে ত্যাগ করল । তখন ক্ষুধার জ্বালায় প্রপীড়িত সেই দুষ্ট চিন্তা করতে লাগল---“এখন কি করি, কোথায় যাই ? কোথায় গেলে দু’মুঠো খেতে পাই ? অনেকটা চিন্তার পর---চুরি করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই । তখন সে চুরি করার অভিপ্রায়ে নগরের চতুর্দিকে ঘুরতে লাগল । কখনও কখনও রাজার সিপাইদের হাতে ধরা পড়ে, ধনপালের পুত্র মনে করে এবং তার বাবার মাহাত্ম্য মনে করে সিপাইগণ তাকে ছেড়ে দিত । এইরূপভাবে কয়েকবার ছাড়া পাওয়ার পর কোন এক বিশেষ চুরির অপরাধে তাকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয় । রাজা তাকে কঠোর শাস্তি প্রদান করেন এবং চিরকালের মত রাজ্য থেকে বিতাড়িত এবং অবিলম্বে যথেচ্ছা চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন । তখন ধনপালের কনিষ্ঠপুত্র “ধৃষ্টবুদ্ধি” পুনঃ দণ্ডপ্রাপ্তির ভয়ে ভীত হয়ে মহারণ্যে প্রবেশ করল ।

ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পশু-পক্ষীর কাঁচা মাংস ভক্ষণ করতে লাগল । ব্যাধের ন্যায় সবসময় তীর-ধনুহাতে নিয়ে বনে বনে ঘুরে বেড়াত । এইরূপ পাপকাৰ্য্যে লিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও না জানি পূর্বজন্মের কোন সুকৃতিপ্ৰভাবে দৈবানুগ্রহে কৌণ্ডিল্য মুনির আশ্রমে উপস্থিত হল । মুনি তখন বৈশাখ মাসের গঙ্গাস্নান শেষ করে আশ্রমে ফিরছিলেন । এমন সময় দুঃখে-শােকে প্রপীড়িত ‘ধৃষ্টবুদ্ধি’র শরীরে কৌণ্ডিল্য মুনির সিক্তবস্ত্রের এক ফোটা জল স্পর্শ হওয়ায় তার সকল পাপ বিদূরিত হল । সেই দুষ্ট “ধৃষ্টবুদ্ধি” অত্যন্ত কাতরভাবে মুনিকে বলল, “হে ব্রাহ্মণ! আমাকে এমন একটা প্রায়শ্চিত্ত বাব্রতের কথা বলুন যা পালন করে এই অধম দুরাচারমুক্ত হতে পারে ।”

তখন মুনিবর তাকে বললেন--- বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষীয়া মােহিনী নামী একাদশী যা পালন করলে মানুষের বহু জন্মের সঞ্চিত পাপরাশি ভস্মীভূত হয় । অতএব তুমি এই একাদশীব্রত শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন কর ।মুনির নির্দেশে পাপিষ্ঠ ধৃষ্টবুদ্ধি অচিরেই পাপমুক্ত হয়ে দিব্যদেহ ধারণ করে বৈকুণ্ঠলােকে চলে গেল । বশিষ্ঠ মুনি ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে বললেন, হে প্রভু! হে শ্রীরামচন্দ্র! এইব্রত অজ্ঞানকৃত মহামােহনষ্ট করে । তীর্থস্নান, যাগ-যজ্ঞ ও যাবতীয় পুণ্য এই মােহিনী একাদশী ব্রতের সমতুল্য নয় ।


আরো জানুন :

হিন্দুরা কেন পূজোর পর প্রতিমা বিসর্জন দেয় ?

সফলা একাদশী মাহাত্ম্য

বিজয়া একাদশী মাহাত্ম্য

মোক্ষদা একাদশী মাহাত্ম্য

মহাভারত রচনা করেন কে ?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
To Top