![]() |
| পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি গণহত্যার সময় পুড়ে মারা যাওয়া মানুষের কঙ্কাল দেহাবশেষ । সোর্সঃ উইকিপিডিয়া |
আজকের লেখাটা পড়তে গিয়ে হয়তো তোমাদের মন ভার হয়ে আসবে। চোখ ভিজে উঠবে। মনে হবে, এই স্বাধীনতা কি সত্যিই আমাদের প্রাপ্য ছিল? তবে ইতিহাসকে অস্বীকার করা যায় না। ইতিহাস আমাদের সামনে আয়নার মতো দাঁড়ায়, যা আমরা দেখতে চাই না। যা ঘটেছিল, তা আজ আর রূপকথার গল্প নয়, তা ছিল বাস্তব, যা অনেককেই চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। এই লেখাটা সেইসব মানুষগুলোর প্রতি আমার শ্রদ্ধা, যারা কোনোদিন তাদের গল্প বলার সুযোগ পায়নি। আশা করি, এই লেখাটা তোমাদের মনের গভীরে দাগ কাটবে।
আরো জানুনঃ ১৯৪৭ হিন্দু গণহত্যার ইতিহাস - পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ)
১৯৪৭: এক নরমেধ যজ্ঞের রক্তাক্ত উপাখ্যান
কলকাতা ও নোয়াখালিতে মুসলমান নাটকের মহড়া (Rehearsal) দিয়েছিল মাত্র। নাটক মঞ্চস্থ করেছে দেশ বিভাগের অব্যবহিত পূর্বে-পঃ পাঞ্জাবে। বিশ্বের ইতিহাসে এত বড় নরমেধ যজ্ঞ ইতিপূর্বে অনুষ্ঠিত হয়নি। ধর্মোন্মাদ সশস্ত্র মুসলমান। পাকিস্তানকে কাফেরশূন্য করে ইসলামের শাসন প্রতিষ্ঠা তাদের একমাত্র লক্ষ্য। আল্লাহর জয়ধ্বনি দিয়ে আল্লাহর নামে মত্ত উল্লাসে তারা মেতে ওঠে হত্যার মহোৎসবে। মানুষের অভিধানে এমন শব্দ আজও আবিষ্কৃত হয়নি যার দ্বারা সেই তাণ্ডবের পৈশাচিক দানবীয় বীভৎসতা আংশিক ভাবেও প্রকাশ করা যায়। অন্তিম পর্বের এই দাঙ্গার শুরু পঃ পাঞ্জাবের লাহোর শহরে। মার্চ-১৯৪৭। জনৈক শিখ মুসলিম লীগের পতাকা ছিঁড়ে ফেলে। ধ্বনি দেয় পাকিস্তান মুর্দাবাদ, পাকিস্তান ধ্বংস হোক। মুসলমান এইরকম একটি উপলক্ষের জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করছিল। হিংস্র নেকড়ের ন্যায় তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে শিখ মহল্লার ওপর। সমগ্র এলাকা পরিণত হয় এক বিরাট ধ্বংসস্তূপে। নিহত হয় ৩০০০ মানুষ। অধিকাংশই শিখ। যতদূর দৃষ্টি যায়-সারি সারি মৃতদেহ। ভারতীয় সেনাবাহিনীর নর্দান কমান্ডের সৈন্যধ্যক্ষ Lt. General Frank Messervy হেলিকপ্টারে দাঙ্গা-বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন কালে সে দৃশ্য দেখে আতঙ্কে শিউরে উঠেছিলেন।
পশ্চিম পাঞ্জাব: এক বিশাল কসাইখানা
সমগ্র পশ্চিম পাঞ্জাব পরিণত হল এক বিরাট কসাইখানায়। হিন্দু-শিখ, যারা পালাতে পেরেছে তারাই পাড়ি দিয়েছে হিন্দুস্থানে। পায়ে হেঁটে অথবা ট্রেনে। ইংরেজ ঐতিহাসিক Leonard Mosley-র বর্ণনায় মানব ইতিহাসের বৃহত্তম দেশান্তর যাত্রা। লক্ষ লক্ষ মানুষ হেঁটে চলেছে। মাইলের পর মাইল শুধু মানুষের অন্তহীন সারি। এই রকম একটি দলে ছিল ৮,০০,০০০ উদ্বাস্তু। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পবন্ত সিং তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছেন- "চারিদিকে গ্রামগুলি জ্বলছে। পিঁপড়ের সারির মত চলেছে মানুষের স্রোত।" অন্য এক পাইলটের অভিজ্ঞতা: "ঘণ্টায় ২৫০ মাঃ গতিতে হেলিকপ্টার ১৫ মিঃ চালিয়েও দলের শেষ প্রান্ত দেখতে পেলাম না।" (One pilot Flight-Lt. Patwant Singh, would always remember "Whole ant-like herds of human beings walking over open country spread out like cattle in the cattle drives of the Westerns I'd seen, slipping in droves past the fires of the villages burning all around them". Another remembered flying for over fifteen breathtaking minutes at 200 m.p.h. without reaching the end of one column.) ব্রিটিশ ঐতিহাসিক Leonard Mosley ৭৫ মাঃ দীর্ঘ এইরকম একটি হিন্দু-শিখ উদ্বাস্তু দলের উল্লেখ করেছেন। (One convoy of Sikhs and Hindus from West Punjab was 74 miles long...) সর্বস্ব হারিয়ে তারা চলেছে। অসহায় ভীত, সন্ত্রস্ত, ক্ষুধার্ত, আহত, মুমূর্ষু-মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। প্রিয়জন হারিয়ে শোকে-দুঃখে মুহ্যমান, বুকে জমাট বাঁধা ব্যথা-কিন্তু শুকিয়ে গেছে অশ্রুর উৎস! সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য... "বৃদ্ধা মা ছেলের কাঁধে-স্বামীর কাঁধে পঙ্গু রুগ্ন স্ত্রী, শিশু মায়ের কোলে। গর্ভবতী স্ত্রী স্বামীর কাঁধে ভর দিয়ে চলেছে। দিনের পর দিন। বড় দীর্ঘ পথ-শতাধিক মাইল। এই দীর্ঘ দুর্গম পথের পাথেয়? ক্ষুধায় একখানি চাপাটি-তৃষ্ণায় এক চুমুক জল-অনেকের ভাগ্যে তাও জোটেনি, লাহোর থেকে অমৃতসর ৪৫ মাঃ দীর্ঘ এই পথের দুপাশে যেন কবরখানা, সর্বত্র ছড়িয়ে আছে রাশি রাশি মৃতদেহ। তারা হয় নিহত অথবা রোগে মৃত। চলছে শকুনি-গৃধিনী, শিয়াল-কুকুরের মহোৎসব। কুকুরের তো নরমাংসে অরুচি হয়েছে-লিভার ছাড়া অন্য কিছু খায় না। (Men carried invalid wives and mothers on their shoulders, women their infants, they had to endure their burden not for a mile or two but for a hundred, two hundred miles for days on end with nothing to nourish their strength but a chapati and a few sips of water... The forty five miles of road side from Lahore to Amritsar, along which so many passed...every yard of the way, there was a body, some butchered, some died of cholera. The vultures had become so bloated. by their feasts-they could no longer fly, and the wild dogs so demanding in their taste they ate only the livers of the corpses littering the road.) ওই রাস্তার পাকিস্তান অংশে মুসলমান লুটেরা ও জল্লাদের দল ওঁৎ পেতে আছে রাস্তার ধারে। সুযোগ পেলেই দলবদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে হতভাগ্যদের ওপর। হত্যা করে লুট করছে তাদের শেষ সম্বলটুকু।
রক্তে ভেজা ট্রেন
হাজার হাজার মানুষ পালিয়ে এসেছে ট্রেনে। পঃ পাঞ্জাবের প্রতিটি স্টেশন তখন জনারণ্য। "কিন্তু হিন্দু স্কুল মাস্টার ভ্রণবির আর সে সৌভাগ্য হল না। স্ত্রী ও দুটি সন্তান নিয়ে ছ'ঘণ্টা ধরে ট্রেনে বসে আছে। ট্রেন ছাড়ছে না। অবশেষে শুধু ইঞ্জিনটি চলে গেল। হতভাগ্যদের নিয়ে কয়েকটি বগি পড়ে রইল প্ল্যাটফর্মে। তারা শঙ্কিত। চারিদিকে এক অস্বাভাবিক নীরবতা। সহসা এক উন্মত্ত সশস্ত্র মুসলিম জনতা আল্লা-হো-আকবর ধ্বনি দিয়ে আক্রমণ করে ট্রেনটি। নির্বিচারে চলে হত্যা। কাউকে বা ছুঁড়ে ফেলে দেয় প্ল্যাটফরমে। ঘাতকরা তো প্রস্তুত হয়েই আছে। অনেকে দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু সবুজ সার্ট পরা মুসলিম বাহিনী তাদের ধরে হত্যা করে। তারপর সেই মৃত-অর্ধমৃতদের ফেলে দেয় স্টেশনের সামনেই একটি কুয়োয়। স্কুল মাস্টার, তার স্ত্রী ও সন্তানগণ একে অপরকে জাপটে ধরে আছে। গুলি ছুঁড়তে-ছুঁড়তে এগিয়ে আসছে জল্লাদ বাহিনী। আমার স্বামী ও একমাত্র পুত্র গুলিবদ্ধ হল-বলছেন তার স্ত্রী। ছেলে জল জল বলে কাঁদছে, আমি চিৎকার করে সাহায্যের আবেদন করলাম-কিন্তু কেউ এল না। ধীরে-ধীরে তার চোখ বুজে এল। চিরতরে বন্ধ হল কান্না। স্বামী যেন বোবা হয়ে গেছে-মাথা দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। হঠাৎ জোরে দু পায়ে ঝাঁকি দিলেন-তারপর লুটিয়ে পড়লেন নীরব-নীথর। মেয়েরা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। আক্রমণকারীরা আমাদের বাইরে ফেলে দেয়। তুলে নেয় বড় তিন মেয়েকে। বড় মেয়েটির মাথায় আঘাত করা হল। সে 'মা মা' বলে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়...। কিছুক্ষণ পরে ওরা আমার স্বামী ও ছেলের মৃতদেহ ওই কুয়োয় ফেলে দিল। সেই ট্রেনের প্রায় ২০০০ যাত্রীর মধ্যে মাত্র ১০০ জন কোনক্রমে বেঁচেছিল।"
আরো জানুনঃ নোয়াখালী দাঙ্গা: এক পরিকল্পিত দাঙ্গার ইতিহাস
"কাশ্মীরী লাল ট্রেনে চেপে আসছিল ভারতে। সীমান্ত তখনও ১৪ মাঃ দূরে। ট্রেনটি চলছিল খুব ধীরে। এক বগীতে অনেক হিন্দু নারী দেখে একদল মুসলমান লাফিয়ে ট্রেনে ওঠে। ছিনিয়ে নেয় তাদের গহনা। ৬/৭ জন মুসলমান যুবতী মেয়েদের ফেলে দেয় ট্রেন থেকে-তারপর লাফিয়ে পড়ে তাদের উপর। ভয়ে অন্য যাত্রীরা চলে এল কাশ্মীরী লালের কামরায়। পেছন পেছন এল ঘাতকের দল। এবার হত্যা পর্ব। দু'খানি ছোরা কাশ্মীরী লালের পেট এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। লুটিয়ে পড়ে সে মেঝেতে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গায়ের ওপর পড়ল আর কয়েকটি দেহ। জ্ঞান হারাবার আগে তিনি অনুভব করেন কেউ তাঁর পা থেকে জুতো খুলে নিচ্ছে। পাশের কামরায় ছিল ধনীরাম। তাঁর স্ত্রী ও চাব সন্তান। আক্রমণের টের পেয়েই তাঁরা ঝাঁপ দেয় মেঝেতে। পলকের মধ্যে চাপা পড়ে তারা মৃত-অর্ধমৃতদের স্তূপে। রক্তের স্রোত বইছে। ধনীরাম আঁচলা ভরে সেই রক্ত মাখিয়ে নেয় নিজেদের মুখে জামা-কাপড়ে। জল্লাদরা তাদের মৃত মনে করে চলে যায়।"
![]() |
| গণহত্যা থেকে বেঁচে ফেরা একদল পুরুষ (শিখ), যাদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে তাদের চুল ছোট করে কেটে ফেলা হয়েছিল। |
পেশোয়ার ও শেকপুরার তাণ্ডব
পেশোয়ার। উঃ পঃ সীমান্ত প্রদেশের রাজধানী। এক ব্যাটালিয়ন হিন্দু-শিখ সৈন্য ভারতে আসার অপেক্ষায়। ব্যারাকে একজন শিখ সৈনিক তার রাইফেল পরিষ্কার করছিল। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল মুসলিম সৈন্য নিয়ে মিলিটারি লরী। হঠাৎই শিখ সৈনিকটির রাইফেল থেকে একটি গুলি বেরিয়ে যায়। লাগে মিলিটারি লরীর গায়ে। মুসলিম সৈন্যরা ভাবল তাঁদের লক্ষ্য করেই গুলি ছোঁড়া হয়েছে। তারা গাড়ী থেকে লাফিয়ে পড়ে পাল্টা গুলি বর্ষণ শুরু করে। খবর গেল Brig. G.R.Morris-এর কাছে। ছুটে এলেন তিনি। বন্ধ হল গোলা-গুলি। "কিন্তু বন্ধ হয় না গুজব। রটে গেল যে শিখ-সৈন্যরা মুসলমানদের হত্যা করছে। হাজার হাজার বন্দুকধারী পাঠান বাসে, ট্রাকে, টোঙ্গা ও ঘোড়ায় চেপে এল পেশোয়ার। মাত্র ৭দিনে নিহত হয় ১০ হাজার হিন্দু-শিখ। দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে গোটা রাজ্য জুড়ে।" (...the rumour that Sikh soldiers were killing their Moslem Comrades swept the tribal areas... Pathan tribesmen swept into the city in trucks, buses, tonga carts, on horseback. This time, however, they came not to demonstrate but to murder. And murder they did. Ten thousands lives would be lost in barely a week... Inevitably, in its wake similar outbursts swept the frontier province.)
শেকপুরা। লাহোরের উত্তরে একটি বাণিজ্য শহর। সেখানে ছিল ব্যাঙ্কার্সদের এক বিরাট Go-down। শহরের সকল হিন্দু-শিখকে সেই গোডাউনে জড়ো করা হয়। গোডাউনের দরওয়াজা তো একটিই। সেই পথে প্রবেশ করে পাক-পুলিশ ও প্রাক্তন ফৌজিদের একটি দল। হাতে তাদের মেসিনগান। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে সকলকে হত্যা করা হয়। জীবিত একজনও ছিল না। (In Sheikhpura, a trading town north of Lahore, the entire Sikh and Hindu community was herded into an enormous Go-down...once inside, the helpless Hindus were machine gunned by Muslim police and army deserters. There were no survivors.)
নেহেরু ও মাউন্টব্যাটেনের ভূমিকা
অমৃতসর রেল স্টেশন। পঃ পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের দখলে। গোটা স্টেশন চত্বর জুড়ে মানুষ থিক্ থিক্ করছে। দাঙ্গায় সব বিচ্ছিন্ন। স্বামী-স্ত্রী, মা-ছেলে, ভাই-বোন যে যেমন ভাবে পেরেেেছ চলে এসেছে ভারতে। তাই পাকিস্তান থেকে ট্রেন এলেই শুরু হত হুড়োহুড়ি, চিৎকার-কোলাহল। চিৎকার করে হারানো আপন জনকে ডাকছে-খুঁজছে তন্ন-তন্ন করে প্রতিটি কামরা।
![]() |
গণহত্যার পর পুড়ে যাওয়া ভবনগুলি পরিদর্শন করছেন মাউন্টব্যাটেন |
আরো জানুনঃ কলকাতার দাঙ্গা ১৯৪৬: প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের রক্তাক্ত ইতিহাস
ভারত ভাগ করে নেহেরু ভারতের প্রধানমন্ত্রী। জলস্রোতের মত আসছে উদ্বাস্তু স্রোত-বিরামবিহীন। পাকিস্তানের পৈশাচিক দাঙ্গার কাহিনি প্রকাশিত হয়। দেখা দেয় দিল্লিতে উত্তেজনা। নেহেরু ভীত হলেন। প্রমাদ গুনলেন। গভর্নর জেনারেল মাউন্টব্যাটেন সিমলায়। নেহেরুর কাতর অনুনয়ে তিনি রাজধানীতে ফিরে এলেন। ছুটে গেলেন নেহেরু ও প্যাটেল। একান্ত বাধ্য ছাত্রের ন্যায় তাকালেন মাউন্টব্যাটেনের দিকে। (...like a pair of chastened school boys) বড় অসহায় দৃষ্টি...। নেহেরু বললেন, অবস্থা অগ্নিগর্ভ। "আমরা জানি না কীভাবে সামলাব।" মাউন্টব্যাটেন বললেন, "তোমাদেরই সামলাতে হবে।" নেহেরু মাউন্টব্যাটেনের গুণমুগ্ধ! তিনি মিনতি করে বললেন, 'আমাদের অভিজ্ঞতা নেই।... আপনি অভিজ্ঞ দক্ষ প্রশাসক, রণক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ সৈন্য পরিচালনার অভিজ্ঞতা আপনার আছে। তাছাড়া আপনারা ইংরেজ, সারাজীবন আমাদের শাসন করেছেন-আজ এভাবে ছেড়ে যেতে পারেন না। গভীর সংকট। আপনার সাহায্যের প্রয়োজন। আপনি কি দায়িত্ব নিতে পারেন না?"
মাউন্টব্যাটেন বললেন, "যদি কেউ কখনও জানতে পারে যে দেশের শাসন ক্ষমতা তোমরা আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়েছ তবে তোমাদের রাজনৈতিক জীবনের সেখানেই ইতি..."। নেহেরু বললেন, "সে ব্যাপারটি আমরা দেখছি... কিন্তু আপনি দায়িত্ব না নিলে আমরা নিরুপায়।"... অতঃপর মাউন্টব্যাটেন সম্মত হলেন। তিনি বললেন, ইমারজেন্সি কমিটি আমার মনোনীত লোকদের নিয়ে গঠিত হবে। নেহেরু বাধা দিয়ে বলেন, (শুধু কমিটি কেন) গোটা মন্ত্রিসভাই তিনি তাঁর মনোনীত ব্যক্তিদের নিয়ে পুনর্গঠিত করতে পারেন। স্থির হয় কমিটির সভায় প্রধানমন্ত্রী নেহেরু মাউন্টব্যাটেনের ডানে ও উপ-প্রধানমন্ত্রী মিঃ প্যাটেল বাঁ পাশে বসবেন। মাউন্টব্যাটেন তাঁদের সঙ্গে আলোচনার ভান করবেন। তাঁরা বিনা বাক্যব্যয়ে তাঁর প্রস্তাবে সম্মতি জানাবেন।... (("We don't know how to hold it" Nehru admitted. "You have to grip it"-Mountbatten. told him "Ho can we grip it? Nehru replied. "We have no experience."... "You are a professional high level administrator. You've commanded millions of men...you English can't just turn this country over to us after being here all our lives and simply walk away. We're in an emergency and we need help. Will you run the country?" "But this is terrible." Mountbatten said, "If any one ever finds out you've turned the contry back to my hands, you'll be finished politically..."Well, said Nehru, We'll have to find a way to disguise it, but if you don't do it, we can't manage".... The Emergency committee', Mountbatten continued, must consist of the people I nominate, 'Oh, Protested Nehru, you can have the whole cabinet!" 'At the meetings Mountbatten continued', the Prime Minister will sit on my right and the Dy. Prime Minister on my left. I'll always go through the motions of consulting you, but whatever I say you're not to argue with me. We have't got time. I'll say: "I'm sure you'd wish me to do this," and you will say "Yes please do.")' কি অসহায় আত্মসমর্পণ। আর জাতির সঙ্গে কি নির্লজ্জ প্রতারণা।
আরো জানুনঃ কেন হত্যা করা হয়েছিল শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে?
এখানেই শেষ নয়।' মাত্র দিন-কয়েকের মধ্যেই মুসলমানদের সুরক্ষার জন্য ইংরেজের হাতেই ফিরিয়ে দেওয়া হল দেশের শাসনক্ষমতা (Executive Power)। Collins এবং Lapierre- এর তাই তির্যক মন্তব্য- "তিন দশকের সংগ্রাম-কত ধর্মঘট-হরতাল, গণ আন্দোলন, বিলেতী বস্ত্রের বহৃৎসব; সর্বোপরি মাত্র তিন সপ্তাহের স্বাধীনতার পর, ভারত-পুনরায় শাসন করছে একজন ইংরেজ" (After three decades of struggle, after years of strikes, mass movements, after all the bonfires of British clothes/ above all, after barely three weeks of independence, India was once again for one last moment being run by an Englishman.)
শাসনক্ষমতা গ্রহণ করেই মাউন্টব্যাটেন গঠন করেন Emergency Committee। কমিটির প্রথম অধিবেশন। মাউন্টব্যাটেন জারি করেন কঠোর নির্দেশ। ভারত থেকে মুসলমানদের নিয়ে পাকিস্তানগামী প্রতিটি ট্রেনে থাকবে সশস্ত্র প্রহরী। তা সত্ত্বেও যদি কোন ট্রেন আক্রান্ত হয়-নিহত হয় মুসলমান যাত্রী-তবে ওই গাড়ীর রক্ষীদের গ্রেফতার করে (আহতদের বাদ দিয়ে) সেই স্থানে তৎক্ষণাৎ কোর্টমার্শাল করে তাদের হত্যা করতে হবে। (...If the security guards on trains failed to open fire on their assailants, he had a solution to propose. Any time a train was successfully attacked, Mountbatten said, round up it's security guards. Sort out those that were wounded. Then court-Martial and shoot the rest on the spot.)
মুসলমানের নিরাপত্তার জন্য সর্বপ্রকার কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হল। তবু পঃ পাকিস্তানে ব্যাপক ও নৃশংস নরহত্যার প্রতিক্রিয়ায় পূঃ পাঞ্জাবে দাঙ্গা ঠেকানো যায়নি। বহু মুসলমান নিহত হয় বর্বর নৃশংস আক্রমণে। দেশ ত্যাগ করে লক্ষ মুসলমান। কিন্তু এ দাঙ্গা পূঃ পাঞ্জাবেই সীমাবদ্ধ থাকে। হিন্দুর মানসিকতা ও কঠোর সতর্কতামূলক ব্যবস্থার জন্য দিল্লি বা অন্যত্র তার প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। যদিও দিল্লিতে মুসলমানের আগ্রাসী মনোভাব ও প্রকাশ্য প্ররোচনা উত্তেজনা সৃষ্টি করে। পুরাতন দিল্লিতে মুসলমান শ্লোগান দেয়- "হাঁসকে লিয়া পাকিস্তান-লড়কে লেঙ্গে হিন্দুস্থান"। মসজিদে নামাজের সময় জনৈক মোল্লা মুসলমানদের স্মরণ করিয়ে দেয়- "মুসলমান শতশত বৎসর দিল্লি শাসন করেছে; আল্লার দোয়ায়, তারাই আবার শাসন করবে (...In their neighbourhoods in old Delhi, many Moslems were whispering a new slogan put out by the fanatics of the Muslim League: We got Pakistan by right-We 'll take Hindusthan by force. That morning. a Mullah in an Old Delhi mosque had reminded his faithful at prayers, that Moslems had ruled Delhi for centuries and 'Insha-Allah'-God willing, they would again.)
| ইসলামে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত কিছু শিখ ধর্মাবলম্বী |
গণহত্যা, ধর্মান্তরকরণ ও জহরব্রত
১৯৪৭ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে যেমন লক্ষ লক্ষ হিন্দু নিহত হয়, তেমনি লক্ষ লক্ষ হিন্দু-নারী হয় অপহৃতা ও ধর্ষিতা (এদের পরে ইসলামে দীক্ষা দেওয়া হয়), লক্ষ হিন্দুকে করা হয় ধর্মান্তরিত। জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দীঃ লায়ালপুরের বাঘ দাস। পেশায় কৃষক। তিনশ হিন্দুর সঙ্গে তাকে নিয়ে যাওয়া হল মসজিদে। পাশেই পুকুর। সকলে হাত-পা ধুয়ে নিল। মসজিদের ভেতরে তাদের বসতে বলা হল। এলেন মৌলবী। কোরান থেকে পাঠ করলেন কয়েকটি আয়াত। তারপর তিনি বললেন- "এবার তোমাদের সামনে দুটি পথ আছে। হয় মুসলমান হয়ে জীবনকে উপভোগ কর অথবা নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য তৈরি হও।" আমরা ইসলামকেই বরণ করলাম- বাঘ দাসের অকপট স্বীকৃতি। অতঃপর প্রত্যেকের একটি করে ইসলামিক নাম দেওয়া হল। পাঠ করানো হল কোরানের একটি আয়াত। মসজিদ চত্বরে বিশাল কড়াইতে রান্না হচ্ছিল গো-মাংস। সকলকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হল-খেতে দেওয়া হল এক টুকরো করে গো-মাংস। বাঘ দাস নিরামিষাশী। পেট গুলিয়ে তাঁর বমি আসে। চেপে রাখে অনেক কষ্টে। কারণ তা না হলে মৃত্যু অবধারিত। তাঁর পাশেই ছিল এক ব্রাহ্মণ। তিনি মুসলমানদের বললেন- "এ বড় শুভ উৎসব। আপনারা অনুমতি দিন, স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে বাড়ি গিয়ে বিয়েতে যৌতুক পাওয়া সুন্দর প্লেট ও কাঁটাচামচ নিয়ে আসি। মুসলমানরা খুশি হয়ে সম্মত হল। ব্রাহ্মণের বাড়িতে একখানি ছোরা ছিল। সে প্রথমে স্ত্রী, পরে তিন সন্তানের এবং সর্বশেষে আপন বক্ষে আমূল বিধিয়ে দিল শাণিত ছুরিকা। (Bagh Das, a Hindu farmer in a hamlet west of Lyallpur, was marched with three hundred fellow Hindus to a mosque set by a small pond in a neighbouring village. Their feet were washed in the pond, then they were herded into the mosque and ordered to sit cross-legged on the floor. The maulavi read a few verses of the Koran. "Now" he told them, "You have the choice of becoming Moslems and living happily or being killed." "We preferred the former" acknowledged Das. Each convert was given a new Moslem name and made to recite a verse from the Koran. Then they were herded into the mosque's courtyard where a cow was roasting. One by one the Hindus were made to eat a piece of its fleslı. Das, a vegetarian until that instant "had a vomiting sensation," but he controlled it because, he thought I will be killd if I do not obey their command." His neighbour, a Brahmin, asked permission to take his wife and three children back to his hut to get his special wedding plates and forks in view of the importance of the moment. Flattered, his Moslem captors agreed. The brahmin had a knife hidden in his house, Das remembered. When he got home, he took it from his hiding place. He cut his wife's throat, then the throat of his three children. Then he stabbed his own heart.') পশ্চিম পাকিস্তান জুড়ে এই হিন্দু-হত্যায় পাক-পুলিশ ও সেনাবাহিনী শুধু সহায়তাই করেনি-তারা প্রত্যক্ষভাবে অংশও নিয়েছে।
৭১২ খ্রীঃ সিন্ধু-রাজ দাহির মহিষী রাণী বাই পুর-ললনাদের নিয়ে প্রথম "জহরব্রত" অনুষ্ঠান করেন। সেইদিন থেকে নারীত্বের মর্যাদা রক্ষায় "জহর ব্রতই" হল ভারতীয় নারীর শেষ অস্ত্র। পঃ পাকিস্তানে হিন্দু-শিখ বিরোধী জেহাদে হাজার হাজার হিন্দু-শিখ নারী পালন করে জহরব্রত। সম্ভ্রম রক্ষার জন্য আত্মহুতি দেয় প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে। অথবা অন্যভাবে করে আত্মহত্যা।
![]() |
| গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া দুই শিশু, যাদের শরীরের বেশ কিছু জায়গা দগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। |
কুলদীপ সিং। বয়স ১৪। বাড়ি লাহোরের উত্তরে একটি গ্রামে। গ্রামে ৬০০ মুসলমান ও মাত্র ৫০ জন হিন্দু-শিখের বাস। একদিন প্রতিবেশী মুসলমানেরা তাদের পাড়ায় এসে স্লোগান দেয়- "যদি বাঁচতে চাও, পাকিস্তান ছেড়ে চলে যাও।" আত্মরক্ষার জন্য তারা প্রতিপত্তিশালী এক শিখের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। "মুসলমান বাড়ি আক্রমণ করে। তাদের হাতে তলোয়ার, ছোরা, লম্বা লোহার রড-তার মাথায় কেরোসিনে ভেজানো কাপড় বাঁধা। আমরা উপর থেকে ইট ও পাথর ছুঁড়ে মারি। ওরা বাড়ি ঘিরে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। একজন শিখকে ধরে তার দাড়িতে দেয় আগুন লাগিয়ে। সেই অবস্থায়ও সে একজন মুসলমানকে মেরে গুরু নানকদেবের নাম নিয়ে ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। ওরা বাড়িতে ঢোকে, এক এক জনকে বাইরে নিয়ে এসে হত্যা করে। ভয়ে আমি ছাদে উঠে যাই। মহিলারা সব সেখানে জড়ো হয়েছে। তারা সব দেখছিল। তারা জানে এরপর তাদের পালা-ঘটবে চরম লাঞ্ছনা। অনেকের কোলে ছিল শিশু সন্তান। ছাদে তারা জ্বালায় বিরাট এক অগ্নিকুণ্ড। শেষবারের মত শিশুকে খাওয়ায় মাতৃস্তন্য। প্রথমে সেই অগ্নিকুণ্ডে ছুঁড়ে দেয় আপন সন্তানে-তারপর নিজেরা ঝাঁপ দিয়ে পালন করে "জহরব্রত" (...Kuldip Singh was a 14 year old boy.....one of fifty Hindus and Sikhs in a village of six hundred Moslems north of Lahore...one day their Moslem neighbours surrounded their quarter shouthing "Leave Pakistan or we will kill you. "They fled to the home of the most important Sikh in the village. "The Moslems came with. swords, knives, long irom pikes with kerosene clothes tied on them to burn us. We threw bricks and stones at them, but they were able to set fire to our house. They caught hold of one Sikh and set fire to his beard. Even though his beard was burning, he still killed one Moslem by throwing a big brick at his head. Then he fell down dead uttering the name of the Sikh Guru. They dragged the men outside and killed them in the streets. I ran to the roof. The women were there watching. They knew they would be captured and raped. Some of them had babies in their arms. They made a big fire on the roof. They fed their babies their breast milk, crying of the fate overtaking them. Then they threw the babies in the fire and jumped in after them.)
স্বাধীনতার উপহার ও গণহত্যার সঠিক চিত্র
১৯৪৭ সালে পঃ পাকিস্তানে দাঙ্গায় কত লোক নিহত হয়েছিল? সঠিক সংখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। দাঙ্গা হয়েছে গোটা পাকিস্তান জুড়ে-মার্চ মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। মুসলমান নির্ভয়ে দাঙ্গা করেছে। পাকিস্তান সরকার হিন্দু-শিখদের নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থাই করেনি। প্রত্যাশিতভাবেই মুসলিম পুলিশ-মিলিটারি ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়; কখনও বা সক্রিয়ভাবে অংশও নিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে পঃ পাকিস্তানের ইংরেজ গভর্ণর Francis Mudie-র ৫ সেপ্টেম্বর জিন্নাকে লেখা চিঠিখানি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। "আমি সকলকেই বলছি শিখরা কিভাবে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যাবে সে বিষয়ে আমি বিন্দুমাত্র চিন্তিত নই। মূল সমস্যা হল কত শীঘ্র পাকিস্তান শিখদের হাত থেকে মুক্ত হতে পারে।" (I am telling everyone that I don't care how the Sikhs get across the border; the great thing is to get rid of them as soon as possible.) দাঙ্গায় হতাহত সম্পর্কে ভারত সরকার আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা ২৫-৩০ লক্ষ। দাঙ্গার ব্যাপকতা, ভয়াবহতা, পাক সরকারের সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়তা (পরোক্ষ সহযোগিতা) ও ১৫,০০,০০০ হিন্দু-শিখের দেশত্যাগের বিচারে এ সংখ্যা অতিরঞ্জিত বলে মনে হয় না। বিচারপতি G.D. Klosla র মতে নিহত হয়েছে ৫,০০,০০০। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক Leonard Mosley তাঁর বিখ্যাত The Last Days of The British Raj গ্রন্থে লিখেছেন, "নিহত ৬,০০,০০০, অপহৃতা নারী ১,০০,০০০ (উভয় দেশ)। পঃ পাকিস্তান থেকে ১৪,০০,০০০ হিন্দু-শিখ ভারতে আশ্রয় নেয়। পূর্ব পাকিস্তান (পূব বঙ্গ) থেকে আসে ১০,০০,০০০। ১৯৫০ সালের পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে আরও এক কোটিরও বেশি হিন্দু ভারতে আসে। পাকিস্তান কার্যতঃ হিন্দুশূন্য হয়। পক্ষান্তরে সাড়ে তিন কোটি মুসলমান ভারতে থেকে যায়। এই পরিসংখ্যান থেকেই উভয় সরকারের ভূমিকা ও দাঙ্গার হতাহত (হিন্দু-মুসলমান উভয় জাতির) সম্পর্কে একটি সমাক চিত্র পাওয়া যায়।
১৯৪৭ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে এবং তার পরে পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে সেটা দাঙ্গা নয় নয়, গণহত্যা (Genocide)। Holocaust বললেও হয়তো সব বলা হল না। আকারে জার্মানীতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় অনুষ্ঠিত Holocaust অপেক্ষা কিঞ্চিৎ ক্ষুদ্র হলেও প্রকৃতিতে শতগুণ ভয়ংকর।
তথ্যসূত্রঃ
- Collins and Lapierre, Freedom at Midnight, p
- Collins and Lapierre-Freedom at Midnight, P-320
- Leonard Mosley-The Last Days of The British Raj, p. 280
- Collins and Lapierre-Freedon at Midnight, P-320-322
- Collins and Lapierre-Freedon at Midnight, P-298-299
- Ibid, P-299-300
- Ibid, P-329
- Collins & Lapierre-Freedom At Midnight, P-272
- Ibid, P-289
- Collins and Lapierre-Freedon at Midnight, P-287-288
- Ibid, P-287
- Collins and Lapierre-Freedon at Midnight, P-314-316
- Collins and Lapierre-Freedon at Midnight, P-316
- Ibid, P-318
- Ibid, P-254




